Image default
ঘটমান বর্তমান

নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপই পৃথিবীর প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ!

নারী ক্রিকেট খেলার ইতিহাসের শুরু হয় পুরুষ বিশ্বকাপেরও আরো দুই হাজার বছর আগে থেকে! 

বৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিশু; প্রশ্ন করলে বেশিরভাগই উত্তর আসে ছেলেদের খেলা বা ছেলেরাই বেশি খেলে! বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ধারণা থেকে ক্রিকেটকে মেয়েদের খেলা হিসেবে খুব কমই দেখা হয়। কিন্তু অত্যন্ত মজার একটা বিষয় হলো, পুরুষদের হয়ে যাওয়া এই খেলাটির প্রথম বিশ্বকাপ আসর ছিলো আসলে নারীদের নিয়ে! পুরুষ ক্রিকেট বিশ্বকাপ শুরু হয় ১৯৭৫ সালে আর তারও দুই বছর আগে, শুরু হয় নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপ। 

পৃথিবীর প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ

আইসিসি কর্তৃক ইংল্যান্ডে ১৯৭৩ সালে প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়। বিশ্বকাপের উদ্বোধন করেছিলেন ইংল্যান্ডের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী স্যার জ্যাক হেওয়ার্ড। তার উৎসাহ এবং অর্থায়নেই এই বিশ্বকাপটি সফল হয়েছিলো। আর এই বিশ্বকাপ আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত নারী ক্রিকেটার র‍্যাচেল হেইহো ফ্লিন্ট। তার নেতৃত্বেই ইংল্যান্ড নারী ক্রিকেট দল এই বিশ্বকাপে জয় লাভ করে। র‍্যাচেল হেইহো ফ্লিন্ট শুধু দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দেননি বরং বর্তমান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারী ক্রিকেট প্রচলিত হওয়ার পিছনেও তাঁর অবদান ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। 

নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপের সাফল্য দেখেই পরবর্তীতে পুরুষ  ক্রিকেট বিশ্বকাপের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয় এবং এখান থেকে ক্রিকেট খেলা বিশ্বব্যপী পরিচিতি লাভ করা শুরু করে।

নারী ক্রিকেটের সূচনা

নারীদের ক্রিকেট খেলা

নারী ক্রিকেট খেলার ইতিহাসের শুরু হয় পুরুষ বিশ্বকাপেরও আরো দুইশো বছর আগে থেকে। নারী ক্রিকেটের প্রথম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ১৭৪৫ সালের ২৬ জুলাই ‘দ্য রিডিং মার্কারি’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। এটিকে নারীদের মধ্যে প্রথম রেকর্ডকৃত ক্রিকেট ম্যাচ বলা হয়। খেলাটি খেলতে দেখা যায় ইংল্যান্ডের সাররে গিল্ডফোল্ডের কাছে দুটি গ্রাম ব্রেমলে এবং হেম্বালডনের মধ্যে। সেই গ্রামের গৃহপরিচালিকারা তাদের নিজেদের মধ্যে এই খেলার আয়োজন করেছিলেন।  

১৮০০ সালের শেষভাগের আগ পর্যন্ত নারীদের মাঝে সামাজিকভাবেই ক্রিকেট খেলার প্রচলন ছিল। এর পরপরই ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায় প্রথম নারীদের ক্রিকেট ক্লাব ‘দ্য হোয়াইট হেথার’। এর ঠিক তিন বছর পর ‘অরিজিনাল ইংলিশ লেডি ক্রিকেটের দল’ ইংল্যান্ডে ভ্রমণ করেন এবং প্রথমবারের মতো দর্শকদের সামনে একটি ক্রিকেট ম্যাচ খেলেন। বলা যায়, এখান থেকে নারীদের পেশাদার ক্রিকেট খেলার সুযোগ তৈরি হয়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অস্ট্রেলিয়া ১৮৯৪ সালে প্রথম নারীদের ক্রিকেট লিগ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এরপর ধীরে ধীরে দক্ষিণ আফ্রিকায় ও পোর্ট এলিজাবেথে তৈরি হতে থাকে নারীদের ক্রিকেট দল ও পাইওনিয়ারস নারী ক্রিকেট ক্লাবসহ বিভিন্ন ক্লাব।

নিউজিলান্ডের নারী ক্রিকেট দল

নারী ক্রিকেটের প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

নারী ক্রিকেটে লিগের প্রচলনের পর এবার পালা প্রথম নারী আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের। নারী ক্রিকেটের  প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল  ১৯৩৪ সালে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে। এই বছরেই অনুষ্ঠিত হয়ে প্রথম নারী টেস্ট ম্যাচ। এদিকে ১৯৩৫ সালে নিউজিল্যান্ডও নারী ক্রিকেট টেস্ট সিরিজের আয়োজন করে এবং নারী ক্রিকেট আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাত্রা শুরু হয়।

নারী ক্রিকেটের বিস্তার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কার পর ১৯৫০ এর দশকে নারী ক্রিকেটের বিস্তার ঘটে আরও কয়েকটি দেশে।

পাশাপাশি জাতীয় দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার শুরু হয় এবং বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়।

যদিও নারী ক্রিকেট খেলা অনেক আগে থেকেই শুরু হতে দেখা যাচ্ছে কিন্তু গত ৫০ বছরে নারীদের খেলা সীমিত ওভার ক্রিকেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২০০৩ সালে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট  চালুর মাধ্যমে নারীদের ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা আরও বাড়তে শুরু করে। ২০০৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স ক্রিকেট কাউন্সিল (IWCC), ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল(ICC) এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে নারী ক্রিকেটের জন্য আরো উন্নতমানের একটি কাঠামো তৈরি করে। এতে অর্থায়ন ও বৈশ্বিক প্রসারের সুযোগও তৈরি হয়। কিন্তু অন্যান্য নারীদের খেলাধুলার মতো নারীদের ক্রিকেটের উন্নয়নও বাধাগ্রস্থ হয়েছে লিঙ্গ বৈষম্য ও কাঠামোগত সহায়তার অভাবে। 

বর্তমানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীরা ক্রিকেট বিশ্বকাপ এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপসহ বেশ কয়েকটি বড় টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছে। এখন ক্রিকেট বোর্ডগুলো বিভিন্ন নতুন ফরমেট ব্যবহার করে প্রতিযোগিতা আয়োজন করার চেষ্টা করছে । এসব চেষ্টার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য ক্রিকেট আয়োজন অন্যতম।

বাংলাদেশের বাঘিনীরা

বাংলাদেশও নারী ক্রিকেটে পিছিয়ে নেই। সব রকম বাঁধা পেরিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। কিন্তু বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটের ইতিহাস এত সহজ ছিল না। এর কিছু বিবরণ পাওয়া যাবে মিশু চৌধুরীর নব্য প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটের অভিযাত্রা’ বইটিতে। বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিষেক ঘটে ২০০৭ সালে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে খেলার মাধ্যমে।

তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল আইসিসি-র অধীনে আসে ২০১১ সালে। এসময় তাদের ওয়ানডে (ODI) এবং টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক মর্যাদা দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের এসিসি নারী এশিয়া কাপে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন রোমানা আহমেদ। এই খেলায় ভারতকে তিন উইকেটে হারিয়ে বাংলাদেশ শিরোপা জয় করে, যা ছিলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের নারীদের জন্য একটি বড় মাইলফলক। বর্তমানে তারা টি-টোয়েন্টি নারী বিশ্বকাপ ২০২৪-এ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে।

বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দল

সাফল্যের পথে যত বাধা

এত বড় ইতিহাসের পরও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। সেটা হলো নারী ক্রিকেটাররা কি পুরুষ ক্রিকেটারদের সমান আচরণ ও মর্যাদা পায়? দুঃখজনক হলেও সত্য, উত্তরটি হলো, ‘না’ । ২১শ শতাব্দীর ২৪তম বছরে এসেও নারী ক্রিকেটারদের বিভিন্ন কারণে বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। শুধু আমাদের দেশই নয় বরং পৃথিবী অনেক উন্নত দেশেও প্রতিনিয়ত ঘটছে এই অসমতা। পুরুষদের ক্রিকেট থেকে নারীদের ক্রিকেটে পারিশ্রমিক, প্রশিক্ষণের সুযোগ, স্পন্সেরশিপ ও বাণিজ্যিক চুক্তি এবং মিডিয়া কভারেজ এর মধ্যে বিশাল পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা প্রায়শই নারী ক্রিকেটারদের রাস্তার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। প্রচলিত সামাজিক ধারণার বসেই  অনেক মেয়েরা ক্রিকেট খেলার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক সম্মতি ও উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে এগিয়ে যেতে পারছে না। হয়েতো আজকে ক্রিকেটের সাথে পুরুষদের নাম জড়িয়ে না থাকলে এই চিত্রটি হতে পারত ভিন্ন ।

যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট উল্লেখযোগ্য সাফল্যতা পেয়েছে তবুও তাদের পারিশ্রমিক এবং সুযোগ-সুবিধা এখনো পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। দেখা গেছে, সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া নারী ক্রিকেটার পুরুষদের দলের সর্বোচ্চ উপার্জনকারীর আট ভাগের এক ভাগ উপার্জন করে থাকে। এই বছরের জুনে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) চুক্তিবদ্ধ মহিলা ক্রিকেটারদের জন্য বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়। বেতনের সর্বোচ্চ মান এক লাখ টাকায় উন্নীত আর সর্বনিম্ন পঞ্চাশ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। পাঁচ বছর আগের অবস্থার তুলনায় যা উন্নত বলা যায় কেননা, তখন একজন নারী ক্রিকেটার প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ত্রিশ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারতেন। এমনকি গত বছর নভেম্বরে খবরে এসেছিল চুক্তিবদ্ধ ২৫জন নারী খেলোয়াড় পাঁচ মাসেও কোন বেতন পান নি।

কিন্তু এই সব রকম বৈষম্য ও বাধা পেরিয়ে নারী ক্রিকেটাররা এগিয়ে যাচ্ছে সারা বিশ্বজুড়ে। নারীদের ক্রিকেটের এই ইতিহাস নারীদের দৃঢ়তা,অদম্য ইচ্ছা শক্তি ও সংকল্পের প্রতীক হয়ে থাকবে সর্বকাল। 

রেফারেন্স

Related posts

চীনের ডিপসিক – মার্কিন শেয়ার মার্কেটে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধ্বস

আবু সালেহ পিয়ার

‘কিংস পার্টি’ বাহাস: শুরুতে আলোচনায়, শেষে ধরাশায়ী

USAID ও ট্রাম্প-মাস্কের যত পাঁয়তারা

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More