Image default
যাপন

সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফোন ধরলে যা ঘটে

সকালে ঘুম থেকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরলে চোখে যেমন চাপ পড়ে, তেমন মনও সতেজ থাকে না, স্ট্রেস বেড়ে যায় এবং দিনটা অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।পাশাপাশি মস্তিষ্কের বিশ্রাম কমে যায়, যা সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

সকাল সকাল বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে হঠাৎ চোখ খুলতেই প্রথমেই আপনি যা খুঁজেন, সেটা কি আপনার মা-বাবা, এক কাপ চা… নাকি মোবাইল ফোন?……………ভুল না করলে ৯৫ শতাংশ মানুষই বলবে, “আমার ফোনটা!” 

স্মার্টফোন আসার পর থেকেই এ যেন এক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ঘুম ভাঙে ফোনের অ্যালার্মে, আর অ্যালার্ম বন্ধ করার পরপরই হাত চলে যায় ইন্টারনেট চালু করতে। মুহূর্তেই ভেসে আসে একের পর এক নোটিফিকেশন। আর সেগুলো দেখতে দেখতেই কেটে যায় ২০ থেকে ৩০ মিনিট, তারপরই অনেকের দিন শুরু হয়। 

তবে এই অভ্যাস হয়তো আপনাকে সাময়িক আনন্দ দিচ্ছে, কিন্তু নিজের অজান্তেই সারাদিনের কাজের ছন্দ ভেঙে দিচ্ছে। শুধু মানসিক ক্ষতিই নয়, এর প্রভাব পড়ছে আপনার শরীরেও। বিশেষ করে ঘুম ভাঙার পরপরই মোবাইল ফোন ঘাঁটলে আপনি নিজেই ডেকে আনতে পারেন নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। 

জানেন কি, দিনের শুরুতেই স্মার্টফোন ব্যবহার কীভাবে আপনার শরীরের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে? আসুন জেনে নিই – একটু খুঁটিয়ে দেখি, এই একটুখানি ‘সকালে ফোন ধরা’ আমাদের শরীর, মন, সম্পর্ক, এমনকি আত্মার উপর পর্যন্ত কী প্রভাব ফেলে।

চোখ খুলতেই ‘স্ক্রিন’

এক সময় অনেকের কাছেই সকাল মানে ছিল, মুখ ধুয়ে, সৃষ্টিকর্তার নাম করে দিন শুরু করা। অনেকের জন্য পাখির ডাক, আবার কারও জন্য প্রিয়জনের হাসিমুখ ছিল নতুন দিনের শুভেচ্ছা। আর বর্তমানে? ‘স্ক্রিন অন, মানে দিন শুরু!’

ঘুম ভাঙার পর ফোন হাতে না নিলে যেন মনে হয় কিছু একটা ঘাটতি রয়ে গেছে। এখনকার প্রজন্মের কাছে ‘সকালের চা’ মানেই ইনস্টাগ্রাম ফিডে চোখ বুলানো, না হয় ফেসবুক নোটিফিকেশন দেখা বা হোয়াটসঅ্যাপে কার মেসেজ এলো, তা চেক করা।

অনেকেই তো আবার ঘুম থেকে ওঠার আগেই, আধঘুমের মধ্যেই মোবাইল স্ক্রল করতে থাকে। এই অভ্যাসের নামই এখন হয়েছে ‘স্লিপ স্ক্রলিং’। এতে শুধু শরীরই নয়, বরং পুরো মস্তিষ্কটাই ঠিকভাবে জাগে না। যার ফলাফল? দিনজুড়ে মনোযোগের অভাব, ভুলে যাওয়া আর কাজের মধ্যে অস্থিরতা।

ঘুম ভেঙে প্রথম দেখাই যদি হয় “ব্রেকিং নিউজ” বা “নেগেটিভ পোস্ট”?

আপনি ভাবছেন, এক কাপ চা নিয়ে একটা সুন্দর সকাল কাটাবেন। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই চোখ পড়ে ফেসবুক স্ক্রলে। কারও আত্মহত্যার স্ট্যাটাস, কোথাও বন্যার ভয়াবহ দৃশ্য, কিংবা রাজনৈতিক উত্তপ্ত বিতর্কে গালিগালাজ। মুহূর্তেই মন-মেজাজ বিগড়ে গেল। আপনার সুন্দর সকালে যেন মুহূর্তেই অন্ধকার নেমে আসলো। 

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ঘুম ভাঙার পরপরই আমাদের মস্তিষ্ক থাকে সবচেয়ে সংবেদনশীল অবস্থায়। এই সময়টা, যাকে বলা হয় ‘হাইপার-রিসেপ্টিভ ফেজ’, তখন আপনি যা দেখেন বা শুনেন, তা সারা দিনের আবেগ-অনুভূতিকে প্রভাবিত করে। তাই এসময় একবার নেতিবাচক কিছু দেখলে, তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলা খুবই কঠিন।

তাহলে ভেবে দেখুন, সকালটা আপনি কী দিয়ে শুরু করছেন?আনন্দ আর আশায়, নাকি দুঃখ আর অশান্তিতে? আপনার গোটা দিনটাই নির্ভর করছে সেই প্রথম কিছুমিনিটের উপর।

ফোনের স্ক্রিন

সকালে ফোন ধরলে আপনার “ডোপামিন” কী বলে?

সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফোন ধরার মুহূর্তে, আমাদের মস্তিষ্ক ডোপামিন নামের এক আনন্দ হরমোন নিঃসরণ করে। নতুন মেসেজ, লাইক, টিকটকের ট্রেন্ড—এসবই মস্তিষ্কে ছোট ছোট ‘রিওয়ার্ড হিট’ দিয়ে যায়। এতে আমরা সাময়িক আনন্দ পাই, কিন্তু নিজের অজান্তেই মস্তিষ্ক অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এই সহজ আনন্দে।  

এইভাবেই তৈরি হয় এক ফাঁদ, যা মূলত বানিয়েছে আমাদের নিজেরই মস্তিষ্ক। ফলে প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর মস্তিষ্ক নিজেই ফোন খুঁজে ফেরে। কারণ সে জানে, ওখানেই মিলবে ডোপামিনের ত্বরিত ডোজ।

কিন্তু সমস্যা হয় তখন, যখন এই ডোপামিনের মাত্রা দিনের শুরুতেই এতটা বেড়ে যায়, যে বাকি দিনের ছোট ছোট আনন্দ আর তেমন ভালো লাগে না। যার ফলাফল সারাদিন ক্লান্তি, মনমরা ভাব, বিরক্তি আর একঘেয়েমি। কোনো কিছুতেই যেন আর ভালো লাগার অনুভূতি আসে না।

সম্পর্কের ওপর প্রভাব

সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রেমিকার মেসেজ না পেলে আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে এমন একধরনের অস্থিরতা দেখা যায়, যেন পৃথিবী থেমে গেছে।

“সে আমাকে গুড মর্নিং বলল না কেন?”, “মেসেজ সিন করেও রিপ্লাই দিল না?”—এইসব প্রশ্নই দিনের শুরুতে মনোযোগকে ঘায়েল করে দেয়। অদ্ভুত ব্যাপার তাই না প্রেম, বিশ্বাস, ভালোবাসা এখন ‘নোটিফিকেশন স্টেটাস’ নির্ভর করে! 

একটা সময় ছিল, যখন সম্পর্কের ভিত্তি ছিল আত্মিক সংযোগ। আর এখন? সেসবের জায়গায় এসেছে ভার্চুয়াল সংবেদনশীলতা। ভালোবাসা যেন হয়ে উঠেছে একরকম ‘ডেলিভারড’ আর ‘রিড’ স্টেটাস নির্ভর ইমোশন, যা কেবল ভুল বোঝাবুঝি বাড়াচ্ছে না, বরং সম্পর্কের প্রকৃত মূল্যবোধকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

শরীরের ওপর প্রভাব—ঘাড়ব্যথা,  ব্রেন ফগ

ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল হাতে নেওয়ার পর আমরা সাধারণত কাত হয়ে বা বালিশে মাথা ঠেকিয়ে স্ক্রল করতে থাকি। প্রথম দেখায় এটি নিরীহ মনে হলেও, এভাবে ফোন দেখার ফলে ঘাড়ের ওপর অসম চাপ পড়ে। দিনে দিনে এই অভ্যাস থেকেই তৈরি হয় ‘টেক্সট নেক’ নামের এক যন্ত্রণাদায়ক সমস্যা। যেখানে ঘাড় ও পিঠে ক্রমাগত ব্যথা অনুভব হয়।

এদিকে চোখ তখনো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। হঠাৎ মোবাইলের তীব্র আলো চোখে পড়তেই শুরু হয় সমস্যা। যেমন -চোখে জ্বালা, মাথাব্যথা, ঝাপসা দেখা এমনকি মস্তিষ্কে তৈরি হতে পারে ‘ব্রেন ফগ’, অর্থাৎ ঝাপসা ভাব বা মনঃসংযোগের ঘাটতি।

আর সবচেয়ে চেনা সমস্যাটা কী জানেন?

অ্যালার্ম বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ ইনস্টাগ্রামে ঢুকে পড়া। তারপর সেখান থেকে ফেসবুক, ফেসবুক থেকে ইউটিউব…! একটার পর একটা ভিডিও, পোস্ট, রিল—এইভাবে সকাল ৮টা থেকে কখন ৯টা বেজে যায়, নিজেই বুঝে উঠতে পারেন না।

ফলাফল? সকালটা হয় অলসতায় ভরা, আর মাথার ভেতরে এক ধরনের ক্লান্তি আর অস্থিরতা নিয়ে সারাদিনটা দৌড়ে কাটে।

ঘাড়ব্যথায় কাতর একজন ব্যাক্তি

চোখের ওপর সকালের স্ক্রিনের প্রভাব

ঘুম থেকে উঠে চোখ তখনো আধোঘুমে, ধীরে ধীরে আলো সহ্য করার চেষ্টা করছে। ঠিক সেই সময়ই, মোবাইলের স্ক্রিন যেন দুপুরের মতো তীব্র আলো নিয়ে এসে পড়ে সরাসরি চোখে। এই আচমকা আলো চোখের জন্য একধরনের ধাক্কা—যা দিনে দিনে হয়ে উঠছে মারাত্মক অভ্যাস।

দীর্ঘ সময় ধরে উজ্জ্বল স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলে চোখে চাপ পড়ে, বিশেষ করে সকালে যখন চোখ এখনো আলো সহ্য করার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। এর ফলে দেখা দিতে পারে চোখে জ্বালা, অস্বস্তি, এমনকি মাথাব্যথা ও ফোলাভাব পর্যন্ত।

চোখ শুকিয়ে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে আসা কিংবা মাঝে মাঝেই চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিতে ইচ্ছা হওয়া—এসবই ডিজিটাল চোখের ক্লান্তির লক্ষণ।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে ফোনের স্ক্রিনে তাকানো মানে চোখকে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই একেবারে এক্সাম হলে ঢুকিয়ে দেওয়া!

এই অভ্যাস দীর্ঘমেয়াদে চোখের স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, এমনকি প্রয়োজন হতে পারে চোখের ড্রপ, চশমা কিংবা চিকিৎসা পর্যন্ত।

দীর্ঘ সময় মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকায় চোখে চাপ পড়েছে

নিজেকে হারিয়ে ফেলার শুরু 

সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফোন ধরার মানে শুধু স্ক্রলিং নয়। বরং, এটা নিজেকে চিনে নেওয়ার, নিজের সঙ্গে সময় কাটানোর সবচেয়ে মূল্যবান সুযোগটাকে হারিয়ে ফেলার নাম।

যেখানে একসময় সকাল মানে ছিল, এক কাপ চায়ের পাশে নিজের ভাবনার জগতে ভেসে যাওয়া, মা-বাবার সঙ্গে দু-একটা হেসেখেলে কথা বলা, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে নিজের দিনটাকে শুভেচ্ছা জানানো। কিন্তু এখন সেই সকালটা কোথায়?

সব কিছু যেন ডুবে গেছে স্টোরি, রিল আর টাইমলাইনের জোয়ারে। এখন আমরা জানি কে কোথায় ঘুরল, কে কী খেল, কার সম্পর্ক ভাঙল বা জুড়ল। কিন্তু নিজের ভেতরে কী চলছে, সেটা জানার সময় নেই।

এই অভ্যাস দিনে দিনে আমাদের আত্মচিন্তার ক্ষমতাকে ক্ষয় করে দিচ্ছে। আমরা ধীরে ধীরে গড়ে তুলছি এক ভার্চুয়াল ‘আমি’—একটা ফিল্টার দেওয়া, লাইক-কেন্দ্রিক সত্তা, যেটা হয়তো মানুষ দেখে, কিন্তু সেটা আমরা নই।

আসল ‘আমি’ হারিয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেটের শব্দে, অন্যের জীবনে উঁকি দেওয়ার ভিড়ে, আর সেই নিঃশব্দ হারিয়ে যাওয়ার খবর আমরা নিজেরাও জানি না।

সকালের ফোন ধরার কিছু ভালো দিকও কি আছে?

নিশ্চয়ই আছে! ফোন ধরলেই যে সব খারাপ, তা নয়। অনেকেই আছেন, যাঁরা ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই চালু করেন ‘জার্নালিং অ্যাপ’। যেখানে লিখে ফেলেন নিজেদের লক্ষ্য, অনুভব, কিংবা দিনের পরিকল্পনা। আবার কেউ হয়তো মেডিটেশন অ্যাপ বা ব্রিদিং এক্সারসাইজ দিয়ে শুরু করেন দিন, কেউ আবার শুনে ফেলেন এক-দুই মিনিটের প্রেরণাদায়ক ভিডিও বা পডকাস্ট, যা তাঁকে সারা দিনের জন্য ইতিবাচক মনোভাব দেয়।

সুতরাং মোবাইল নিজে খারাপ নয়। খারাপ হতে পারে আমরা কীভাবে তা ব্যবহার করছি।

এখানে আসল প্রশ্নটা হলো—
“আপনি কনটেন্টটা বেছে নিচ্ছেন তো?” “আপনি কি ফোনকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, নাকি ফোনই আপনাকে চালিয়ে নিচ্ছে?”

যদি আপনি নিজের ইচ্ছায়, নিজের প্রয়োজন মাফিক ফোন ব্যবহার করেন। তাহলে ফোন আপনার শক্তি হয়ে উঠবে। কিন্তু যদি আপনি নোটিফিকেশন, স্ক্রল আর অ্যালগরিদমের দাস হয়ে যান। তবে সেটাই হয়ে উঠবে দিনের শুরুতে এক বিষাক্ত ফাঁদ।

তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনি যদি সচেতন হন, আপনার সকালের সময়টাকে একটু নিজের মতো করে সাজান, তাহলে এই ‘মোবাইলের শেকল’ থেকে বের হওয়া সম্ভব। একটা ভালো সকাল মানেই হতে পারে একটা ভালো দিন, আর একটার পর একটা ভালো দিন।

তাই, আগামীকাল সকালে ঘুম ভাঙার পর একটু দেরি করে ফোন ধরুন। প্রথমে নিজেকে ধরুন, নিজেকে খুঁজুন। কারণ, স্ক্রিন নয়—সকালের আলোতেই লুকিয়ে থাকে জীবনের সত্যিকার জাগরণ।

 তথ্যসূত্র- 

Related posts

সময় কম? দেখে নিন আপনার জন্য উপযুক্ত ব্যায়াম

নারীর যে অভ্যাসগুলো রেড ফ্ল্যাগ

যে বিষয়গুলো একজন পুরুষকে অনাকর্ষণীয় করে তোলে: আচরণ, অভ্যাস ও ডেটিং ভুল

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More