মারুলা ফল খেয়েই মাতাল হয় হাতি, করে উদ্ভট আচরন
আমরা যখন মাদকাসক্তি নিয়ে কথা বলি, তখন সাধারণত মানুষের কথাই আমাদের মনে আসে। কিন্তু আপনি কি জানেন, প্রকৃতির বুকেও এমন কিছু প্রাণী আছে, যারা নিয়মিত মাদক সেবন করে এবং নেশাগ্রস্ত আচরণ করে? শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, এটিই সত্যি! অনেক প্রাণী জেনে আবার অনেকে না জেনে এই নেশা করে থাকে। কেউ কেউ আবার শারীরিক অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেতে নেশা করে থাকে।
এই অদ্ভুত বিষয়টি নিয়ে জানতে পারলে আপনার মাথাও ঘুরে যেতে পারে। চলুন, প্রকৃতির এই নেশাগ্রস্ত দুনিয়ায় ডুব দেওয়া যাক।
নেশাগ্রস্ত হতেই কি প্রাণীরা মাদক গ্রহণ করে!
মানুষের মতো প্রাণীরাও কি আনন্দের জন্য মাদক সেবন করে? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে? বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে চমকপ্রদ কিছু তথ্য পেয়েছেন। কিছু প্রাণী অনিচ্ছাকৃতভাবে মাদক গ্রহণ করে ফেলে যখন তারা নির্দিষ্ট কিছু গাছপালা বা ফল খায়। আবার কিছু প্রাণী সচেতনভাবেই মাদকের উৎস খুঁজে নেয়। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে।
প্রথম কারণটা হতে পারে খাদ্যের অংশ হিসেবে। অনেক গাছপালা, ছত্রাক বা ফল প্রাকৃতিকভাবেই সাইকোঅ্যাক্টিভ যৌগ ধারণ করে। প্রাণীরা যখন এগুলো খায় তখন অনিচ্ছাকৃতভাবে তারা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকায় হাতিরা গাঁজন হওয়া মারুলা ফল খেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়।
আগেই বলেছি শারীরিক ব্যাধি সারাতেও অনেক প্রাণী মাদক গ্রহণ করে থাকে। কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, প্রাণীরা ব্যথা কমানোর জন্য, সংক্রমণ দূর করতে বা রোগ নিরাময়ের জন্য নির্দিষ্ট কিছু উদ্ভিদ বা ছত্রাক গ্রহণ করে। এটি এক প্রকার স্ব-চিকিৎসার উদাহরণ। যেমন, কিছু শিম্পাঞ্জি নির্দিষ্ট পাতার নির্যাস খায় পেটের পরজীবী দূর করতে, যার মধ্যে কিছু সাইকোঅ্যাক্টিভ উপাদান থাকতে পারে।
কী মনে করেন, শুধু মানুষই কৌতূহল উদ্দীপক হয়ে থাকে। নাহ, প্রাণীরাও কৌতুহল উদ্দীপক হয়ে থাকে। মানুষের মতোই কিছু প্রাণী নতুন অভিজ্ঞতা লাভে আগ্রহী হয়। অনেক সময় তারা কৌতূহলবশত মাদক গ্রহণ করে, যা তাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের উদ্দীপনা তৈরি করে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, কিছু প্রাণী কেবল কৌতূহলবশতই মাদক গ্রহণ করে থাকে।
জীবন পরিচালনা করতে মানুষের মতোই প্রাণীদেরও শক্তি ও বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। শক্তি বৃদ্ধি বা পরজীবী দমনে কিছু প্রাণী নিজেদের শক্তি বাড়াতে অথবা শরীরে থাকা পরজীবী দমনের জন্য নির্দিষ্ট কিছু উদ্ভিদ বা পোকামাকড় গ্রহণ করে, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে নেশাগ্রস্ত আচরণ দেখা যায়। যেমন, কিছু পাখি নির্দিষ্ট পোকামাকড় খায় যা তাদের শরীরে অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক প্রভাব ফেলে কিন্তু একইসাথে তাদের মধ্যে এক ধরনের ঘোরের সৃষ্টি করে।
হাতি: মাতাল হওয়ার ওস্তাদ!
আমরা অনেক সময় পাগলা হাতির গল্প শুনি, সংবাদ পড়ে থাকি। হাতিদের নেশা করার গল্পও খুবই জনপ্রিয়। কখনো কি ভেবে দেখেছেন হাতির এরকম মাতালের মতো আচরণ করার পেছনে কারণ হিসেবে মাদক গ্রহণ হতে পারে? হ্যাঁ এমনটা হতেই পারে। তারা প্রাকৃতিকভাবে গাঁজন (fermentation) হওয়া ফল বিশেষ করে মারুলা ফল (Marula fruit) খেয়ে নেশা করে থাকে।
যখন মারুলা ফল পেকে মাটিতে পড়ে, তখন এর শর্করা গাঁজন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অ্যালকোহলে রূপান্তরিত হয়। হাতিরা যখন প্রচুর পরিমাণে এই ফল খায়, তখন তারা মাতাল হয়ে যায়। তাদের আচরণেও এর প্রভাব স্পষ্ট দেখা যায়। তারা টলতে টলতে হাঁটে, অদ্ভুত শব্দ করে, একে অপরের সাথে ধাক্কা খায় এবং কখনও কখনও ঘুমিয়েও পড়ে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সাফারি পার্কগুলোতে এই দৃশ্য বেশ পরিচিত এবং পর্যটকদের কাছে এটি একটি আকর্ষণীয় বিষয়। তবে, বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে এখনও গবেষণা করছেন যে, হাতিরা সত্যিই অ্যালকোহলে মাতাল হয় নাকি এই আচরণের পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে। তবুও, তাদের নেশাগ্রস্ত আচরণ এক অসাধারণ দৃশ্যই বটে।
বাঁদরের মাদক গ্রহণের অভ্যাস
বাঁদরের দল তো এমনিতেই সারাদিন লাফালাফি করে। তবে কখনো মাদক সেবন করেও লাফালাফি করে। বাঁদরেরাও মাদক গ্রহণে পিছিয়ে নেই। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সেন্ট কিটস দ্বীপে সবুজ মাকড়সা বাঁদরদের (Vervet Monkeys) মধ্যে অ্যালকোহল পান করার প্রবণতা দেখা যায়।
এই বাঁদরগুলো মানুষের ফেলে দেওয়া বা গাঁজন হওয়া আখ বা ফলের রস থেকে উৎপাদিত অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় পান করে। অনেক সময় তারা পর্যটকদের পানীয় থেকেও চুমুক দেয়! এই পর্যটকদের পানীয় নিয়ে পান করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন অনেকে।
বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে, এই বাঁদরগুলোর মধ্যে প্রায় ১০-১৫% নিয়মিত মদ্যপান করে এবং তাদের মধ্যেও মানুষের মতোই বিভিন্ন স্তরের আসক্তি দেখা যায়। কিছু বাঁদর মদ্যপানের পর শান্ত হয়ে যায়, আবার কিছু আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এই আচরণগুলো মানুষের অ্যালকোহল সেবনের পর দেখা যাওয়া আচরণের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়, যা প্রাণীর মনস্তত্ত্ব নিয়ে নতুন ভাবনা তৈরি করে।
মাশরুম, মানুষের খাবার আর প্রাণীর নেশা
সাইবেরিয়ার বল্গাহরিণ (Reindeer) এক বিশেষ ধরনের নেশার প্রতি আসক্ত। তারা এক প্রকার সাইকোঅ্যাক্টিভ মাশরুম, যার নাম আমানিতা মাস্কারিয়া (Amanita muscaria) খেয়ে থাকে। এই মাশরুমের মধ্যে মাস্কিমল (Muscimol) নামক একটি যৌগ থাকে, যা হ্যালুসিনেশনের কারণ।
বল্গাহরিণ এই মাশরুম খাওয়ার পর এক অদ্ভুত ঘোরে চলে যায়। তারা এলোমেলোভাবে দৌড়ায়, লাফায় এবং অদ্ভুত আচরণ করে। স্থানীয় শামানরা (Shamans) অনেক সময় এই হরিণগুলোর মূত্র পান করত, কারণ মাশরুমের সক্রিয় উপাদান তাদের মূত্রের মাধ্যমেও শরীর থেকে বের হয় এবং মূত্রপানেও একই ধরনের নেশা হয়। এটি প্রাকৃতিকভাবে প্রাণীদের নেশা নেওয়ার এক অসাধারণ উদাহরণ।
অন্যান্য প্রাণীর নেশার উৎস
শুধুমাত্র হাতি, বাঁদর বা বল্গাহরিণই নয়, আরও অনেক প্রাণী বিভিন্ন প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
বিড়ালদের ক্যাটনিপ (Catnip)
গাছের প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ রয়েছে। ক্যাটনিপে থাকা নেপেট্যাল্যাক্টন (Nepetalactone) নামক একটি রাসায়নিক বিড়ালদের মস্তিষ্কে এক ধরনের আনন্দ উদ্দীপনা তৈরি করে। যার ফলে তারা উল্টেপাল্টে গড়াগড়ি খায়, মুখ ঘষে এবং খেলার মেজাজে থাকে। এটি এক ধরনের নিরীহ মাদকাসক্তি, যা তাদের আচরণে পরিবর্তন আনে।
কিছু পাখি, যেমন সিডার ওয়াক্সউইং (Cedar Waxwing) এবং রবিন (Robin), অতিরিক্ত পেকে যাওয়া ফল খেয়ে মাতাল হয়ে যায়। শীতকালে যখন তাপমাত্রা কমে যায়, তখন ফলের শর্করা গাঁজন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অ্যালকোহলে রূপান্তরিত হয়। এই ফল খেয়ে পাখিগুলো দিকভ্রান্ত হয়ে উড়ে এবং কখনও কখনও গাছের ডালে ধাক্কা খেয়ে পড়েও যায়।
স্কটল্যান্ডের ভেড়ারা কিছু নির্দিষ্ট লাইকেন (Lichen) খেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়। এই লাইকেনগুলোতে অ্যালকোহল-সদৃশ যৌগ থাকে, যা ভেড়াগুলোকে উত্তেজিত করে তোলে।
কিছু ডলফিন পাফারফিশ (Pufferfish) নিয়ে খেলা করে। পাফারফিশ যখন হুমকির মুখে পড়ে, তখন তারা টেট্রোডোটক্সিন (Tetrodotoxin) নামক এক প্রকার স্নায়ুবিষ নির্গত করে। অল্প পরিমাণে এই বিষ ডলফিনদের মধ্যে এক প্রকার ঘোরের সৃষ্টি করে, যা তারা উপভোগ করে বলে মনে করা হয়। এটি প্রাণীজগতে মাদক গ্রহণের উদাহরণ হিসেবে একটি নতুন সংযোজন।
তাসমানিয়ায়, কিছু ক্যাঙ্গারু এবং ওয়ালাবিস পোস্ত ক্ষেতের (Poppy fields) উপর আক্রমণ করে এবং পোস্তর অন্দরে থাকা আফিম (Opium) গ্রহণ করে। এর ফলে তারা ঘোরের মধ্যে চলে যায় এবং অস্বাভাবিকভাবে ঘোরাফেরা করে, বৃত্তাকারে দৌড়ায় বা একে অপরের ওপর পড়ে যায়।
নেশা করা প্রাণীর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও গবেষণা
প্রাণীদের মাদকাসক্ত আচরণ নিয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। তাদের মূল লক্ষ্য হলো, প্রাণীদের মস্তিষ্কে এই যৌগগুলো কীভাবে কাজ করে এবং এর ফলে তাদের আচরণে কী ধরনের পরিবর্তন আসে তা বোঝা। এই গবেষণার মাধ্যমে মানুষের মাদকাসক্তি এবং এর চিকিৎসায় নতুন দিক উন্মোচিত হতে পারে। নেশার বৈজ্ঞানিক কারণ এবং প্রাণীদের উপর এর প্রভাব মানুষের আসক্তি বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বিজ্ঞানীরা প্রাণীজগতের এই অদ্ভুত প্রবণতাকে ‘Zoopharmacognosy’ নামে অভিহিত করেছেন। এটি এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে প্রাণীরা তাদের অসুস্থতা নিরাময়ের জন্য বা সুস্থ থাকার জন্য প্রাকৃতিক উদ্ভিদ, মাটি, পোকামাকড় বা অন্যান্য পদার্থ ব্যবহার করে। মাদকের ব্যবহারও এর একটি অংশ হতে পারে। এই গবেষণাগুলি প্রমাণ করে যে, আসক্তি এবং নেশা শুধু মানবজাতি নয়, প্রাণীজগতেরও একটি অংশ। প্রকৃতির এই অদ্ভুত আচরণ সম্পর্কে যত গভীরে আমরা প্রবেশ করি, ততই আমরা বুঝতে পারি যে, পৃথিবী এবং এর জীবজগত কত বিচিত্র ও রহস্যময়!
তথ্যসূত্র
- https://en-m-wikipedia-org.translate.goog/wiki/Recreational_drug_use_in_animals?_x_tr_sl=en&_x_tr_tl=bn&_x_tr_hl=bn&_x_tr_pto=rq
- https://www.ittefaq.com.bd/amp/246377/%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4-%E0%A6%A1%E0%A6%B2%E0%A6%AB%E0%A6%BF%E0%A6%A8
- https://www-quora-com.translate.goog/What-animals-like-humans-use-drugs-for-fun?_x_tr_sl=en&_x_tr_tl=bn&_x_tr_hl=bn&_x_tr_pto=tc
- Couch, J. (2007). “Drunken animals.” BBC Wildlife Magazine, 25(12), 48-52.