মাথায় হাত দিলেই উঠে আসছে চুল। চিন্তায় মাথায় হাত। সব ধরনের শ্যাম্পু, তেল ব্যবহার করা শেষ। কিন্তু চুল পড়া থামানো যাচ্ছে না কোনভাবেই। এই সমস্যার পেছনে এমনকিছু কি আছে যার কারণে চুল পড়া বন্ধ হচ্ছে না?
সকালে ঘুম থেকে উঠে বালিশে কয়েকটি চুল, গোসলের পর বাথরুমে জমে থাকা চুল, কিংবা চিরুনি আঁচড়ানোর পর তাতে আটকে থাকা চুল; এই দৃশ্যগুলো আমাদের প্রায় সবারই পরিচিত। চুল পড়া একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া হলেও, যখন তা অতিরিক্ত মাত্রায় হতে থাকে, তখন তা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ চুল শুধু আমাদের সৌন্দর্যই বাড়ায় না, এটি আমাদের আত্মবিশ্বাসেরও একটি বড় অংশ। তাই চুল ঝরতে শুরু করলে আমরা নানা ধরনের ঘরোয়া টোটকা বা বিজ্ঞাপনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিভিন্ন পণ্য ব্যবহার শুরু করি, যার মধ্যে বেশিরভাগই চুলের জন্য ক্ষতিকর।
আজকের লেখায় আমরা চুল পড়ার পেছনে থাকা বৈজ্ঞানিক কারণগুলো সহজভাবে বোঝার চেষ্টা করব এবং জানব এর প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে।
চুলের জীবনচক্র: কেন স্বাভাবিকভাবেই কিছু চুল পড়ে?
একটি বিষয় অনেকেই জানেন না আর তা হলো প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০টি চুল পড়া সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কারণ এটি চুলের জীবনচক্রের একটি অংশ। তবে সমস্যা তখনই শুরু হয়, যখন চুল পড়ার হার এর চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায় এবং নতুন চুল গজানোর হার কমে আসে।
আমাদের মাথার প্রতিটি চুল একটি নির্দিষ্ট জীবনচক্রের মধ্যে দিয়ে যায়, যার মূলত তিনটি ধাপ রয়েছে:
১. অ্যানেজেন (Anagen) বা বৃদ্ধির ধাপ: এটি চুলের জীবনচক্রের সবচেয়ে দীর্ঘ ধাপ, যা ২ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই ধাপে চুল সক্রিয়ভাবে বাড়তে থাকে। আমাদের মাথার প্রায় ৮৫-৯০% চুলই যেকোনো মুহূর্তে এই ধাপে থাকে।
২. ক্যাটাজেন (Catagen) বা অবস্থান্তর ধাপ: এটি একটি ছোট পর্যায়, যা প্রায় ২-৩ সপ্তাহ স্থায়ী হয়। এই ধাপে চুলের বৃদ্ধি থেমে যায় এবং চুলের গোড়া বা ফলিকল সংকুচিত হতে শুরু করে।
৩. টেলোজেন (Telogen) বা বিশ্রামের ধাপ: এটি চুলের জীবনচক্রের শেষ ধাপ, যা প্রায় ৩ মাস স্থায়ী হয়। এই ধাপে চুল বিশ্রামে থাকে এবং ফলিকলের গোড়া থেকে আলগা হতে শুরু করে। এই ধাপের শেষেই চুলটি স্বাভাবিকভাবে ঝরে পড়ে এবং সেই জায়গা থেকে একটি নতুন চুল গজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
যখন কোনো কারণে এই স্বাভাবিক চক্রটি ব্যাহত হয়, অর্থাৎ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি চুল একবারে টেলোজেন ধাপে প্রবেশ করে, তখনই অতিরিক্ত চুল পড়া বা হেয়ার ফলিং শুরু হয়।
চুল পড়ার মূল বৈজ্ঞানিক কারণ কী কী?
চুল পড়ার সমস্যাটি একক কোনো কারণে হয় না, এর পেছনে থাকতে পারে একাধিক কারণ। নিচে প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো:
১. জেনেটিক্স বা বংশগতি (Androgenetic Alopecia)
চুল পড়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো বংশগতি। এটি পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। পুরুষদের ক্ষেত্রে এটিকে ‘মেল প্যাটার্ন বল্ডনেস’ বলা হয়, যেখানে সাধারণত কপালের দুই পাশ এবং মাথার তালু থেকে চুল পড়া শুরু হয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে এটিকে ‘ফিমেল প্যাটার্ন থিনিং’ বলা হয়, যেখানে পুরো মাথার চুলই ধীরে ধীরে পাতলা হতে শুরু করে, তবে পুরোপুরি টাক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এর মূল কারণ হলো ‘ডাই হাইড্রো টেস্টোস্টেরন’ বা DHT নামক একটি হরমোন, যা চুলের ফলিকলকে সংকুচিত করে ফেলে এবং নতুন চুল গজানোতে বাধা দেয়।
২. হরমোনের তারতম্য: জীবনের বিভিন্ন ধাপ:
শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা চুল পড়ার একটি অন্যতম প্রধান কারণ, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়।
গর্ভাবস্থা ও প্রসব পরবর্তী চুল পড়া:
গর্ভাবস্থায় ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় চুল পড়া অনেকাংশে কমে যায় এবং চুল অনেক ঘন মনে হয়। কিন্তু সন্তান জন্মের পর হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসায়, যে চুলগুলো এতদিন পড়েনি, সেগুলো একবারে ঝরতে শুরু করে। এটি একটি অস্থায়ী সমস্যা এবং সাধারণত কয়েক মাসের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে যায়।
থাইরয়েড সমস্যা:
থাইরয়েড গ্রন্থির অতিরিক্ত সক্রিয়তা (হাইপারথাইরয়েডিজম) বা কম সক্রিয়তা (হাইপোথাইরয়েডিজম) উভয় ক্ষেত্রেই চুল পড়া বাড়তে পারে। থাইরয়েড হরমোন চুলের জীবনচক্র নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS):
PCOS-এ আক্রান্ত মহিলাদের শরীরে অ্যান্ড্রোজেন বা পুরুষ হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা চুল পাতলা হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
৩. পুষ্টির অভাব: চুলের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার:
এই কারণগুলো ছাড়াও আরেকটি বিশেষ কারণে মাথার চুল পড়া বাড়তে পারে। আর তা হলো চুলের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব। স্বাস্থ্যকর চুলের জন্য সঠিক পুষ্টি অপরিহার্য। আমাদের খাদ্যাভ্যাসে কিছু নির্দিষ্ট পুষ্টির অভাব হলে চুল পড়া বাড়তে পারে। সেই পুষ্টিগুলো হলো-
আয়রন: শরীরে আয়রনের অভাব বা অ্যানিমিয়া হলে চুলের ফলিকলে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না, ফলে চুল দুর্বল হয়ে ঝরে পড়ে।
প্রোটিন: আমাদের চুল কেরাটিন নামক এক ধরনের প্রোটিন দিয়ে তৈরি। খাবারে পর্যাপ্ত প্রোটিনের অভাব হলে চুলের গঠন দুর্বল হয়ে যায়।
জিংক: জিংক চুলের বৃদ্ধি এবং পুনর্গঠনে সাহায্য করে। এর অভাবেও চুল পড়তে পারে।
বায়োটিন ও ভিটামিন বি: বায়োটিন এবং অন্যান্য বি-কমপ্লেক্স ভিটামিন চুলের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
ভিটামিন ডি: নতুন হেয়ার ফলিকল তৈরিতে ভিটামিন ডি-এর ভূমিকা রয়েছে বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
৪. মানসিক চাপ ও অসুস্থতা (Telogen Effluvium)
কোনো বড় ধরনের শারীরিক বা মানসিক চাপের পর হঠাৎ করে অতিরিক্ত চুল পড়া শুরু হতে পারে। যেমন কোনো বড় সার্জারি, গুরুতর অসুস্থতা (যেমন ডেঙ্গু, টাইফয়েড বা কোভিড-১৯), হঠাৎ করে ওজন কমে যাওয়া, অথবা কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু বা মানসিক আঘাতের মতো ঘটনা ঘটলে, আমাদের শরীর একটি ‘’শকিং” অবস্থায় চলে যায়। এর ফলে, একসঙ্গে অনেক চুল বিশ্রাম বা টেলোজেন ধাপে প্রবেশ করে এবং ঘটনার প্রায় ৩ মাস পর সেগুলো একযোগে ঝরতে শুরু করে। এই অবস্থাকে ‘টেলোজেন এফ্লুভিয়াম’ বলা হয়। তবে সুখবর হলো, এটি সাধারণত একটি অস্থায়ী সমস্যা এবং মানসিক চাপ বা অসুস্থতা কেটে গেলে চুল আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
৫. ঋতু পরিবর্তন ও পরিবেশগত কারণ:
অনেকেই একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে, বিশেষ করে বর্ষা বা শরৎকালে, চুল পড়া বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ করেন। একে ‘সিজনাল হেয়ার ফলিং’ বলা হয়। যদিও এর পেছনের কারণ নিয়ে গবেষণা চলছে, তবে ধারণা করা হয়, গ্রীষ্মকালে সূর্যের তাপে চুলের যে ক্ষতি হয়, তার প্রভাব হিসেবেই শরৎকালে চুল বেশি ঝরে। এছাড়া, পরিবেশ দূষণ, অতিরিক্ত ক্ষারযুক্ত জল (হার্ড ওয়াটার) এবং আবহাওয়ার আর্দ্রতার তারতম্যও চুল পড়ার কারণ হতে পারে।
৬. জীবনযাপন
আমাদের দৈনন্দিন কিছু অভ্যাসও চুল পড়ার জন্য ব্যাপকভাবে দায়ী। যেমন- ট্র্যাকশন অ্যালোপেসিয়া বা খুব টেনে চুল বাঁধা, যেমন—আঁটসাঁট খোঁপা বা পনিটেল করার ফলে চুলের গোড়ায় অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং সেই জায়গা থেকে চুল ঝরে যেতে পারে।
চুলে অতিরিক্ত রঙ করা, রিবন্ডিং, বা স্ট্রেইটনিং করার মতো রাসায়নিক প্রক্রিয়া চুলের প্রোটিন গঠনকে নষ্ট করে দেয়, ফলে চুল ভঙ্গুর হয়ে যায় এবং ঝরে পড়ে।
হেয়ার ড্রায়ার, স্ট্রেইটনার বা কার্লিং আয়রনের অতিরিক্ত ব্যবহার চুলের স্বাভাবিক আর্দ্রতা কেড়ে নেয় এবং চুলকে শুষ্ক ও দুর্বল করে ফেলে।
বিজ্ঞানসম্মতভাবে চুল পড়া রোধে করণীয়
চুল পড়ার কারণ অনুযায়ী এর প্রতিকারও ভিন্ন ভিন্ন হয়। তবে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললে চুল পড়া অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সুষম খাদ্যাভ্যাস: প্রোটিন (ডিম, মাছ, ডাল), আয়রন (পালং শাক, কচু শাক, মাংস), জিংক (বাদাম, বীজ), ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (সামুদ্রিক মাছ, ফ্ল্যাক্সসিড) এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাদ্যতালিকায় রাখুন।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ: নিয়মিত ব্যায়াম, যোগব্যায়াম বা মেডিটেশন মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত ঘুম (প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা) অত্যন্ত জরুরি।
চুলের সঠিক যত্ন: সালফেট-মুক্ত হালকা শ্যাম্পু ব্যবহার করুন। ভেজা চুল আঁচড়ানো থেকে বিরত থাকুন, কারণ ভেজা অবস্থায় চুলের গোড়া সবচেয়ে দুর্বল থাকে। কেমিক্যাল এবং হিট স্টাইলিং যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।
চিকিৎসকের পরামর্শ: যদি অতিরিক্ত চুল পড়া অব্যাহত থাকে, তবে দেরি না করে একজন ডার্মাটোলজিস্ট বা ট্রাইকোলজিস্টের পরামর্শ নিন। তিনি রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে আপনার চুল পড়ার আসল কারণ (যেমন হরমোনের সমস্যা বা পুষ্টির অভাব) নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসার পরামর্শ দেবেন। প্রয়োজনে তিনি মিনোক্সিডিল, ফিনাস্টেরাইড (পুরুষদের জন্য), বা পিআরপি থেরাপির মতো চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারেন।
চুল ঘন করার কিছু উপায়
চুল পড়া কমানোর পাশাপাশি চুলকে ঘন এবং স্বাস্থ্যোজ্জ্বল করার জন্য কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।
স্ক্যাল্প ম্যাসাজ: নিয়মিত হালকা হাতে স্ক্যাল্প ম্যাসাজ করলে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, যা চুলের ফলিকলকে উদ্দীপিত করে এবং চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। নারিকেল তেল বা ক্যাস্টর অয়েলের মতো প্রাকৃতিক তেল ব্যবহার করে ম্যাসাজ করলে চুল মজবুত হয়।
প্রাকৃতিক উপাদান: পেঁয়াজের রস, অ্যালোভেরা জেল বা মেথির প্যাকের মতো ঘরোয়া উপাদানগুলো চুলের গোড়াকে পুষ্টি জোগাতে এবং চুলকে ঘন করতে সাহায্য করতে পারে, যদিও এর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সীমিত।
সঠিক পণ্য ব্যবহার: ভলিউমাইজিং শ্যাম্পু এবং কন্ডিশনার ব্যবহার করলে চুল তাৎক্ষণিকভাবে ঘন এবং ফোলা মনে হয়।
চুল পড়া একটি জটিল সমস্যা, কিন্তু এটি অপ্রতিরোধ্য নয়। চুল পড়ার আসল কারণ চিহ্নিত করাই হলো এই সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ। শুধুমাত্র ঘরোয়া টোটকা বা বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর না করে, একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করলেই চুল পড়া সমস্যার কার্যকর সমাধান সম্ভব। মনে রাখবেন, আপনার চুলের স্বাস্থ্য আপনার দৈহিক স্বাস্থ্যেরই প্রতিচ্ছবি। তাই চুলের যত্ন নিন, সুস্থ থাকুন।
তথ্যসূত্র –
- https://www.maxhealthcare.in/blogs/bn/hair-loss-in-women
- https://bangla.thedailystar.net/health/news-493786
- https://www.jugantor.com/doctor-available/793335
- https://www.prothomalo.com/lifestyle/health/%E0%A6%9A%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%AA%E0%A7%9C%E0%A6%BE-%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A7%E0%A7%87-%E0%A6%AF%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%A8
- https://rtvonline.com/lifestyle/282013
- https://www.medicoverhospitals.in/bn/articles/hair-loss-reasons-female
- https://www.prothomalo.com/lifestyle/health/%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9A%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%AA%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A3