Image default
নগর পরিচিতি

হো চি মিন সিটি: ইতিহাস, খাবার আর মোটরবাইকের রাজকীয় শহর

ধরুন আপনি রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছেন, ঠিক এমন সময় ট্রাফিক লাইটে হলুদ বাতি জ্বলে উঠল। আমাদের দেশে হলে আপনি হয়তো ধীর গতিতে গাড়ি চালানো শুরু করবেন।  কিন্তু হো চি মিন সিটিতে মানুষ করে ঠিক উল্টোটা! 

মোটরবাইকে ভরা ব্যস্ত রাস্তা, সুস্বাদু স্ট্রিট ফুড, আর ভিয়েতনামী, চীনা ও ফরাসি প্রভাবের মিশ্রণে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ ইতিহাস শহরটিকে অন্য যেকোনো শহর থেকে করেছে একেবারেই আলাদা। রাস্তার ধারে খাওয়া বান মি বা ফো যেমন স্বাদে মুগ্ধ করবে, তেমনি ঐতিহাসিক কিউ চি টানেল কিংবা সাইগনের নটর ডেম ক্যাথেড্রাল আপনাকে নিয়ে যাবে অতীতের গল্পে।

চলুন জেনে নেই হো চি মিন সিটি সম্পর্কে আরো কিছু জানা-অজানা তথ্য।

হো চি মিন সিটি এর নামকরণ ও ইতিহাস

হো চি মিন সিটি শুধু ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় শহরই নয়, বরং সবচেয়ে প্রাণবন্তও বটে। শহরটির নামের ইতিহাসও বেশ চমকপ্রদ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহুবার এর নাম পরিবর্তন হয়েছে । শুরুতে খমের জনগোষ্ঠী এই জায়গাটিকে ডাকত প্রেই নোকর, যার মানে “অরণ্যের শহর”, অথবা প্রেহ রিচ নোকর, অর্থাৎ “রাজকীয় শহর” নামে। তখন এটি ছিল একেবারে ছোট্ট একটি জেলেপল্লি। পরে যখন ভিয়েতনামিরা এলাকা দখল করে, তখন এর নাম হয় জিয়া দিন।

ভিয়েতনামের যুদ্ধ

১৮৬২ সালে ফরাসিরা নিয়ন্ত্রণ নিলে শহরটির নতুন নাম হয় সাইগন। এই নামেই এটি দীর্ঘদিন বিশ্বে পরিচিত ছিল। তবে ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, শহরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় হো চি মিন। দেশের প্রথম কমিউনিস্ট নেতা হো চি মিন এর নামে এ শহরের নামকরণ করা হয়। আজ আন্তর্জাতিকভাবে শহরটি এই নামেই পরিচিত । তবে মজার ব্যাপার হলো, শহরের অনেকেই বিশেষ করে ডিস্ট্রিক্ট ১–এ এখনো একে ভালোবেসে সাইগন বলেই ডাকা হয়।

হো চি মিন সিটি এর আয়তন ও জনসংখ্যা

হো চি মিন সিটি ভিয়েতনামের প্রাণকেন্দ্রিক একটি শহর। এটি সাইগন নদীর তীরে এবং মেকং নদীর ব-দ্বীপের কাছাকাছি অবস্থিত। ২০২৫ সালে শহরটির জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ছাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শুধু ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় শহরই নয়, এটিই দেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মূল কেন্দ্র এবং সবচেয়ে ব্যস্ত নগরী।

এখানকার অধিকাংশ মানুষই ভিয়েতনামি, যাদের বলা হয় কিন। তবে এর পাশাপাশি বেশ কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও এখানে বসবাস করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো হোয়া সম্প্রদায়। এ সম্প্রদায়  মূলত চীনা বংশোদ্ভূত। তারা নিজেদের চীনা ভাষায় কথা বলে। এছাড়াও এখানে কিছু সংখ্যক খেমার এবং চাম জনগোষ্ঠীরও বসবাস আছে।

ধর্মের দিক থেকে শহরটি বেশ বৈচিত্র্যময়। ভিয়েতনামি ও চীনা বংশোদ্ভূত মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত হলো তাওবাদ, কনফুসিয়ানিজম এবং মহাযান বৌদ্ধধর্ম। তবে এখানেই রয়েছে রোমান ক্যাথলিকদের একটি বড় সম্প্রদায়, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০%।

ভিয়েতনামের মানুষ

শহরে আসা-যাওয়ার জন্য রয়েছে ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর টন সান নোহাত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী, বছরে প্রায় ১৫ মিলিয়ন যাত্রী এই বিমানবন্দর দিয়ে ভ্রমণ করত, যা দেশের মোট বিমানযাত্রীর প্রায় অর্ধেক। আজও এটি ভিয়েতনামের সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দরগুলোর একটি।

অদ্ভুত মোটর সাইকেল সংস্কৃতি

হো চি মিন সিটিতে ঘুরতে গেলে এখানকার মোটরসাইকেল সংস্কৃতি আপনাকে অবাক করবে। মনে হয় এ যেন মোটরসাইকেলেরই শহর। এখানে প্রায় প্রত্যেক বাসিন্দার জন্য একটি করে মোটরসাইকেল রয়েছে। আর এই মোটরসাইকেল ব্যবহার হয় সবকিছুর জন্য। ফ্রিজ ডেলিভারি করা থেকে শুরু করে পুরো পরিবারকে একসাথে বহন করা পর্যন্ত, সব কাজেই মোটরসাইকেলই প্রধান ভরসা। 

যানজটের পরিমাণ অবিশ্বাস্য হলেও এখানকার মোটরসাইকেল সংস্কৃতির নিজস্ব নিয়ম আছে। এখানে চালকরা সাধারণত একে অপরকে হর্ন বাজিয়ে সংকেত দেন এবং খুবই সতর্কভাবে সামনে এগিয়ে যান। তারা বড় ফাঁকা রাস্তার জন্য অপেক্ষায় থাকে না, আর এটাকেই বলা হয় “yielding principle”, ইয়েল্ডিং প্রিন্সিপাল।

মোটসাইকেল এ ফ্রিজ ডেলিভারি

হো চি মিন সিটির আরেকটি অদ্ভুত সংস্কৃতি রয়েছে, সেটি হচ্ছে এ শহরের ট্রাফিক নিয়ম। হো চি মিন সিটির ট্রাফিক নিয়ম সত্যিই মজার।  অন্য অনেক দেশের মতোই হো চি মিন সিটিতেও সবুজ মানে ‘চলুন’ আর লাল মানে ‘থামুন’। 

তবে এখানে একটু ভিন্নতা আছে। আপনি যদি হলুদ বাতি দেখেন, তাহলে ধীরে নয় বরং গাড়ি দ্রুত চালাতে হবে। কারণ এর মানে হলো—রাস্তার মোড় বা ক্রসিং দ্রুত ফাঁকা করতে হবে। হলুদ আলো দেখলেই গাড়ির গতি আরও বাড়িয়ে দেয়! শহরের ট্রাফিক নিয়মের এই অদ্ভুত অভ্যাসটিই যেন আপনাকে প্রথমেই অবাক করে দেবে।

হো চি মিন সিটির কিছু বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান

এবার আসুন হো চি মিন সিটির কিছু বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা যাক। আপনি যদি ইতিহাস, সংস্কৃতি আর আধুনিকতার মিশ্রণ একসাথে উপভোগ করতে চান, তবে এ শহরের প্রতিটি স্থানই আপনাকে ভিন্ন ভিন্ন গল্প শোনাবে।

কিউ চি টানেল

শহররের দর্শনীয় স্থানের কথা বললে প্রথমেই আসবে কিউ চি টানেলের কথা। শহরের বাইরে অবস্থিত এই টানেল ভিয়েতনাম যুদ্ধের এক জীবন্ত দলিল। ভেবে দেখুন তো, ১৫০ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের ভেতরে মানুষ বাস করছে, গোলাবারুদ মজুত করছে, এমনকি হাসপাতালও চালাচ্ছে! যুদ্ধের সময় ভিয়েত কং গেরিলারা এখানেই লুকিয়ে থেকে মার্কিন সেনাদের ওপর আকস্মিক হামলা চালাত। আজ এই টানেলের কিছু অংশ পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত। এর ভেতরে নামলেই অনুভব করবেন ইতিহাস যেন আপনার চারপাশে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

কিউ চি টানেল

নটর ডেম ক্যাথেড্রাল

হো চি মিন শহরের কেন্দ্রেই দাঁড়িয়ে আছে নটর ডেম ক্যাথেড্রাল। ১৮৮০ সালে ফরাসিরা এটি নির্মাণ করেন এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো, এটি নির্মাণের জন্য প্রতিটি উপকরণই ফ্রান্স থেকে আনা হয়েছিল। গথিক শৈলীর বিশাল গম্বুজ, উঁচু টাওয়ার আর ইউরোপীয় ধাঁচের স্থাপত্য শহরটিকে দিয়েছে এক বিশেষ সৌন্দর্য। আপনি যদি ছবি তুলতে ভালোবাসেন, তবে এই ক্যাথেড্রাল আপনার ক্যামেরার জন্য আদর্শ স্থান।

সাইগন স্কাইডেক

আধুনিক ভিয়েতনামকে অনুভব করতে চাইলে অবশ্যই উঠতে হবে সাইগন স্কাইডেকে। বিটেক্সকো ফাইন্যান্সিয়াল টাওয়ার ২৬২ মিটার উঁচু এক আকাশচুম্বী ভবন, যেখানে ৪৯তম তলায় আছে বিখ্যাত স্কাইডেক। সেখান থেকে এক নজরে পুরো শহরটিকে দেখা যায়। দিন হোক বা রাত শহরের ঝলমলে দৃশ্য আপনার ভ্রমণকে করে তুলবে আরও রোমাঞ্চকর। চাইলে ৫০তম তলায় রেস্টুরেন্টে বসে রাতের খাবারের সঙ্গে সঙ্গে এই দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।

সাইগন স্কাইডেক

পিপলস কমিটি ভবন

ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো পিপলস কমিটি ভবন। প্যারিস সিটি হলের আদলে তৈরি এই ভবনটি একসময় ছিল ফরাসি প্রশাসনের কার্যালয়, বর্তমানে এখানে মেয়রের অফিস। সামনের সবুজ পার্ক ও সুন্দর ফুলের বাগান এটিকে ছবি তোলার জন্য একেবারেই উপযুক্ত করে তুলেছে।

সাইগন সেন্ট্রাল পোস্ট অফিস

ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের আরেক নাম হলো সাইগন সেন্ট্রাল পোস্ট অফিস। বিখ্যাত প্রকৌশলী গুস্তাভ আইফেলের নকশায় তৈরি এই ভবনটি ১৮৮৬ থেকে ১৮৯১ সালের মধ্যে নির্মিত হয়। ভেতরে ঢুকলেই মনে হবে আপনি ইউরোপের কোনো পুরোনো রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন। উঁচু গম্বুজ, রঙিন জানালা আর গথিক-রেনেসাঁর মিশ্রণ একে অপূর্ব সৌন্দর্য্য দান করেছে।

স্বাধীনতা প্রাসাদ

ভিয়েতনামের ইতিহাস বোঝার জন্য অবশ্যই ঘুরে দেখতে হবে স্বাধীনতা প্রাসাদ। এখানে ১৯৭৫ সালের ৩০শে এপ্রিল দক্ষিণ ভিয়েতনাম আত্মসমর্পণ করে, এবং যুদ্ধের অবসান ঘটে। পাঁচতলা বিশাল এই প্রাসাদে রয়েছে শতাধিক কক্ষ, আর প্রতিটি কক্ষেই রাজকীয় আসবাবপত্র আর ঐতিহাসিক নিদর্শন। ভেতরে ঢুকলে মনে হবে যেন আপনি সময় ভ্রমণ করছেন।

স্বাধীনতা প্রাসাদ

অবশিষ্টাংশ মিউজিয়াম

আর যদি ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতা কাছ থেকে দেখতে চান, তবে অবশ্যই যেতে হবে যুদ্ধ অবশিষ্টাংশ মিউজিয়ামে। এখানে রয়েছে যুদ্ধকালীন অস্ত্র, সামরিক সরঞ্জাম, ভয়ঙ্কর বোমা হামলার ছবি এবং রাসায়নিক অস্ত্রের প্রভাবের প্রমাণ। প্রদর্শনীগুলো এতটাই হৃদয়স্পর্শী যে এগুলো দেখে আপনি ইতিহাস নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হবেন।

হো চি মিন সিটি মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস

সংস্কৃতি আর শিল্পপ্রেমীদের জন্য আছে হো চি মিন সিটি মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস। ঔপনিবেশিক যুগের প্রাসাদে গড়ে ওঠা এই জাদুঘরে রয়েছে চিত্রকর্ম, সিল্ক প্যানেল, কাঠের খোদাই, সিরামিক আর ভাস্কর্য। শুধু দেশীয় শিল্প নয়, বিদেশি শিল্পীর কাজ ও সমসাময়িক প্রদর্শনীও এখানে স্থান পেয়েছে।

ভিয়েতনামী মেডিসিন জাদুঘর

আপনি যদি চিকিৎসা ইতিহাসে আগ্রহী হন, তবে ভ্রমণ করবেন ঐতিহ্যবাহী ভিয়েতনামী মেডিসিনের জাদুঘরে। এখানে প্রদর্শিত হয়েছে ভেষজ, প্রাচীন চিকিৎসা যন্ত্রপাতি এবং ভিয়েতনামী চিকিৎসা বিজ্ঞানের দীর্ঘ ঐতিহ্য। 

ভিয়েতনামী মেডিসিন জাদুঘর

হো চি মিন সিটি অপেরা হাউস

শহরের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা হো চি মিন সিটি অপেরা হাউস হলো ফরাসি ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের আরেক নিদর্শন। দিনের বেলায় যেমন এটি সুন্দর, রাতের আলোয় সেজে ওঠে আরও রোমান্টিক রূপে। এখানে শুধু অপেরা নয়, নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হয়। 

গোল্ডেন ড্রাগন ওয়াটার পাপেট থিয়েটার

এছাড়াও, ভিয়েতনামের প্রাচীন সংস্কৃতির স্বাদ নিতে চাইলে অবশ্যই দেখতে হবে গোল্ডেন ড্রাগন ওয়াটার পাপেট থিয়েটার। পানির উপর কাঠের পুতুল দিয়ে শত শত বছরের পুরোনো নাট্যশৈলী আজও মঞ্চস্থ হয় এখানে। ভাষা না বুঝলেও এর অভিনয় আপনাকে ভিয়েতনামের সংস্কৃতির গভীরে নিয়ে যাবে।

তান দীন গীর্জা

শহরের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী স্থাপনাগুলোর একটি হলো তান দীন গীর্জা, যেটি পিঙ্ক চার্চ নামেও পরিচিত। গোলাপি রঙে রঙিন এই চার্চ ফরাসি গথিক শৈলীতে ১৮৮০ সালে নির্মিত হয়েছিল। দূর থেকে দেখলেই মনে হয় রূপকথার কোনো প্রাসাদ, আর ভেতরে ঢুকলে এর সূক্ষ্ম সাজসজ্জা মুগ্ধ করে রাখবে।

সুওই তিয়েন থিম পার্ক

পরিবার নিয়ে আনন্দ করতে চাইলে আপনাকে চলে যেতে হবে সুওই তিয়েন থিম পার্ক এ। ১৯৯৫ সালে খোলা এই পার্কে রয়েছে রাইড, চিড়িয়াখানা, ওয়াটার পার্ক, 4ডি সিনেমা এবং ধর্মীয় ভাস্কর্য। প্রবেশের সময় বিশাল ড্রাগনের মূর্তি আপনাকে স্বাগত জানাবে।

সাইগন চিড়িয়াখানা এবং বোটানিক্যাল গার্ডেন 

প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণীপ্রেমীদেরও নিরাশ করবে না হো চি মিন সিট। তাদের ঘোরার জন্য রয়েছে জন্য রয়েছে সাইগন চিড়িয়াখানা এবং বোটানিক্যাল গার্ডেন। ১৮৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই উদ্যানটি ভিয়েতনামের প্রাচীনতমগুলোর একটি। 

এখানে প্রায় ৫০০ প্রাণী আর ১০০-এর বেশি প্রজাতির পাখি রয়েছে। গোলাপি ফ্ল্যামিঙ্গো ও কালো এশিয়ান ভাল্লুক এখানকার বিশেষ আকর্ষণ। আর উদ্ভিদের বিশাল ভান্ডারে রয়েছে কাম্বোডিয়া, লাওস, তাইওয়ান, আফ্রিকা এবং আমেরিকার নানা প্রজাতির গাছ।

সাইগন চিড়িয়াখানা এবং বোটানিক্যাল গার্ডেন

হো চি মিন সিটি উৎসব

হো চি মিন সিটি ভ্রমণে গেলে আপনি শুধু এখানকার বহুমাত্রিক পর্যটন স্থানগুলোই দেখবেন না, বরং সারা বছর ধরে চলতে থাকা উৎসব আর অনুষ্ঠানও অনুভব করতে পারবেন একদম কাছ থেকে। 

টেট উৎসব

হো চি মিন সিটির উৎসব সম্পর্কে বলতে গেলে, সবচেয়ে আগে বলতেই হয় টেট উৎসবের কথা। এটি ভিয়েতনামী নববর্ষ, যা জানুয়ারির শেষ কিংবা ফেব্রুয়ারির শুরুতে পালিত হয়। আপনি যদি এ সময় শহরে থাকেন, তবে দেখবেন প্রতিটি রাস্তা ফুল, লণ্ঠন আর আলোকসজ্জায় ভরে উঠেছে। মানুষজন মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করছে, পরিবার একসাথে হচ্ছে, আর বাজারে সাজানো হয়েছে বিশেষ খাবার ও ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী।

টেট উৎসব

জাতীয় দিবস

তারপর আসে জাতীয় দিবস, ২রা সেপ্টেম্বর। সেদিন শহরে এত ভিড় হয় যে মনে হবে এক বিশাল কনসার্ট চলছে। রাস্তায় প্যারেড হয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে আর রাত নামতেই আকাশ আতশবাজির আলোয় ঝলমল করে ওঠে। 

মধ্য-শরৎ উৎসব

শিশুদের জন্য সবচেয়ে আনন্দময় সময় হলো মধ্য-শরৎ উৎসব। সেপ্টেম্বর মাসে পালিত এই উৎসবে চাঁদের কেক খাওয়া, রঙিন লণ্ঠনের আলো আর শিশুদের মিছিল শহরটিকে পরিণত করে রূপকথার এক দেশে। এ সময় রাস্তায় হাঁটলে দেখতে পাবেন ছোট্ট ছোট্ট হাতের লণ্ঠনের আলোয় চারপাশ কতটা উজ্জ্বল আর প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।

বোনসাই উৎসব

শহরে প্রকৃতি আর সৌন্দর্যের প্রেমিকদের জন্য রয়েছে বোনসাই উৎসব। এ আয়োজনে পার্কগুলোতে যখন ছোট ছোট শিল্পকর্মের মতো গাছপালা সাজানো হয়।

চীনা সম্প্রদায়ের নববর্ষ 

এছাড়া শহরের চায়নাটাউনে বসবাসরত চীনা সম্প্রদায়ের নববর্ষও এক বিশাল উৎসবে রূপ নেয়। তখন পুরো এলাকা ড্রাগন ডান্স, আতশবাজি আর চীনা খাবারের সুবাসে ভরে ওঠে। আপনি যদি সেই সময় চায়নাটাউনে যান, তবে বুঝতে পারবেন ভিয়েতনামের ভেতরেও আরেকটি সংস্কৃতি কতটা জীবন্তভাবে বেঁচে আছে।

চীনা সম্প্রদায়ের নববর্ষ

খাবারের সংস্কৃতি

হো চি মিন সিটির কফি আর খাবারের সংস্কৃতি ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় নতুন স্বাদ যোগ করে দিতে বাধ্য। এই শহরে কফি শুধু পানীয় নয়, বরং জীবনধারা। শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ক্যাফে সুয়া দা। এটি ঘন কালো কফি, কনডেন্সড মিল্ক আর বরফের মিশ্রণ, যা গরম আবহাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। এছাড়া আছে ক্যাফে দেন অর্থাৎ চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি, এগ কফি আর নারকেল কফি। এই প্রতিটি কফিই একেকটা আলাদা অভিজ্ঞতা। মজার বিষয় হলো, শহরের প্রতিটি মোড়ে কফিশপ ভরা, কোথাও ভিনটেজ সাজসজ্জা, কোথাও আবার আধুনিক আড্ডার পরিবেশ।

খাবারের দিক থেকেও ভিয়েতনামী রান্না অসাধারণ বৈচিত্র্যময়। এখানকার জাতীয় খাবার হলো ফো। এটি গরম ঝোল, নুডলস আর মাংসের সাথে ভেষজ মসলা দিয়ে তৈরি যা ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করে দেয় মুহূর্তেই। ফরাসি ছোঁয়া মেলে বান মি-তে। এটি খাস্তা ব্যাগেটে মাংস, সবজি আর সস ভরা এক দুর্দান্ত স্ট্রিট ফুড। নুডলসপ্রেমীদের জন্য হো চি মিন শহরে আছে হু টিউ ও বান ক্যান, আর হালকা খাবারের মধ্যে জনপ্রিয় বান উওত, গই কুয়ন ও বান সেও। দুপুরে ভারী খাবার চাইলে বেছে নিতে পারেন কম টাম, আর এক্সপেরিমেন্ট করতে চাইলে চেখে দেখতে পারেন ভিয়েতনামী শামুকের রান্না। এক কথায়, হো চি মিন সিটি ভ্রমণ মানেই কফি আর স্ট্রিট ফুডের এক দুনিয়ায় হারিয়ে যাওয়া।

এই সকল অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য সাধারণত নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময় হো চি মিন সিটি ভ্রমণ করা উচিৎ। এ সময় আবহাওয়া সুন্দর থাকে, ভ্রমণে কোনো অসুবিধা হয় না। ফলে সারা পৃথিবী থেকে প্রচুর পর্যটক এ সময় এখানে ভিড় জমায়, আর পুরো শহরটা তখন উৎসবমুখর হয়ে ওঠে।

হো চি মিন সিটি শুধু দেখার শহর নয় এটি আসলে অনুভব করার শহর। উৎসবের ভিড়ে দাঁড়িয়ে আতশবাজির ঝলক দেখা হোক, কিংবা রাস্তার পাশে কোন এক কফি শপে বসে এ শহরের বর্ণিল সংস্কৃতি উপভোগ করা;  প্রতিটি মুহূর্ত আপনাকে বলবে এই শহর সত্যিই জীবন্ত। 

তথ্যসূত্র-

Related posts

লাহোর – পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক রাজধানী

স্ল্যাব সিটি- যে শহরে নেই কোন আইন কানুন

সিঙ্গাপুর- দক্ষিণ এশিয়ার লায়ন সিটি

আশা রহমান

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More