Image default
রহস্য রোমাঞ্চ

চীনের স্বর্গরাজ্য জিউঝাইগো- ১১৪টি রঙিন হ্রদ ও লোককথা

যদি বলি পৃথিবীতে এমন এক উপত্যকা আছে যার অসাধারণ সুন্দর লেকগুলোর উৎপত্তি হয়েছে মূলত একটি প্রেমকাহিনীকে ঘিরে, তাহলে কি বিশ্বাস হবে?!

ঝকঝকে নীল-সবুজ পানির হ্রদ, ঝর্ণা আর জলপ্রপাত; বর্ণিল বনভূমি, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তুষার ঘেরা পাহাড় আর বিরল বন্যপ্রাণী; সব মিলিয়ে এ উপত্যকাকে যদি “স্বর্গের উপত্যকা” বলা হয়, তাহলে হয়তো ভুল হবে না। 

বলছি জিউঝাইগো ভ্যালির কথা। চীনের সিচুয়ান প্রদেশে অবস্থিত এ অসাধারণ প্রাকৃতিক উপত্যকা তার রূপকথার মত সৌন্দর্যের জন্য পৃথিবী খ্যাত। 

চলুন, জিউঝাইগো ভ্যালি সম্পর্কে নানা জানা-অজানা তথ্য সম্পর্কে জেনে নেই। 

জিউঝাইগো উপত্যকার অবস্থান

জিউঝাইগো উপত্যকা ভ্যালি হিমালয়ের ঘন অরণ্যের মাঝে লুকানো এক মনোমুগ্ধকর পানির রাজ্য। এটি চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমে, সিচুয়ান প্রদেশের উত্তরে অবস্থিত। এই উপত্যকাটির আয়তন প্রায় ৭২০ বর্গকিলোমিটার। যদি জিউঝাইগোকে স্বর্গ বলা হয়, তাহলে সিচুয়ান প্রদেশকে বলা যায় স্বর্গের দরজা!

আর এর কারণ হলো, এই অঞ্চলের মাত্র ৫০ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে ১৭টি প্রবাহিত ঝর্ণা, ১১৪টি বিচিত্র বর্ণিল হ্রদ, এবং চারপাশে বিস্তৃত পাহাড়ি বনাঞ্চল, যা সমগ্র ভ্যালিকে এক অসাধারণ প্রাকৃতিক চিত্রপটে রূপান্তরিত করেছে।

প্রায় ৩,০০০ বছর আগে এ অঞ্চলে মানুষের বসতি গড়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এখানকার গ্রামগুলোতে বসবাসকারীরা মূলত তিব্বতি জনগণ। এই মানুষেরা নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং জীবনধারার জন্য পরিচিত। তাদের দৈনন্দিন জীবন, আচার-অনুষ্ঠান এবং প্রথায় সবসময়ই স্বকীয়তার ছাপ লক্ষ্য করা যায়।

ম্যাপ

 

 

জিউঝাইগো ভ্যালির নামকরণ

এবার আসি, জিউঝাইগো ভ্যালির নামের ব্যাখ্যায়। জায়গাটির নামের সাথে জড়িয়ে আছে একটি মজার রূপকথার গল্প। স্থানীয়দের মতে, প্রাচীনকালে ৯ জন সুন্দরী, বুদ্ধিমতী ও সাহসী বোন মিলে এই অঞ্চলের সৃষ্টি করেছিলেন। তারা এই উপত্যকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ৯ জন তিব্বতি পুরুষকে বিয়ে করেন এবং পুরো উপত্যকা জুড়ে ৯টি পৃথক গ্রামে বসবাস শুরু করেন। আর সেই থেকেই এ অঞ্চলের নাম হয়েছে জিউঝাইগো। চীনা ভাষায় এর অর্থ হলো “নয় গ্রামের উপত্যকা”।

জিউঝাইগো ভ্যালির নামকরণের গল্প

আরও মজার ব্যাপার হলো, এখানকার অধিকাংশ হ্রদের নামকরণ করা হয়েছে স্থানীয় জনশ্রুতি এবং কাল্পনিক চরিত্রের উপর ভিত্তি করে। যেমন ‘রাইনোসরাস লেক, ড্রাগন লেক, ফাইভ কালার পুল, পান্ডা লেক, পিকক সি’ ইত্যাদি। স্থানীয়রা আবার এই হ্রদগুলোকে ‘হাইজি’ নামে ডাকে। যার অর্থ হলো ‘সমুদ্রের পুত্র’।

জিউঝাইগো সম্পর্কে আরেকটি রূপকথার গল্প লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে। বলা হয়, পর্বতের দেবতা ও তার স্ত্রী, পর্বতের দেবীকে একটি অত্যন্ত স্বচ্ছ আয়না উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু ভুলবশত দেবী আয়নাটি ভেঙে ফেলেন, এবং এটি ১১৪টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী, এই খণ্ডগুলোই পরবর্তীতে পরিণত হয় ১১৪টি স্বচ্ছ পানির হ্রদে। আর দেবতার ভালোবাসার এই বিশেষ উপহার থেকেই জন্ম নেয় জিউঝাইগো ভ্যালির অসাধারণ সুন্দর লেকগুলো।

জিউঝাইগো ভ্যালির সৌন্দর্য

এই ভ্যালি মূলত তিনটি উপত্যকার সমন্বয়ে গঠিত; এগুলো হলো রিজে ভ্যালি, শুঝেং ভ্যালি এবং জেচাওয়া ভ্যালি। প্রতিটি উপত্যকারই নিজস্ব সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এখানে ঘুরতে আসা ভ্রমণকারীদের মুগ্ধ করে তোলে।

রাইনোসরাস লেক

এই ভ্যালিগুলোর মধ্যে শুঝেং ভ্যালি হলো জিউঝাইগোর দর্শনীয় এলাকার প্রধান উপত্যকা এবং একইসাথে এই উপত্যকার প্রবেশদ্বার। শুঝেং ভ্যালির সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে গভীর হ্রদ হচ্ছে রাইনোসরাস লেক। লেকটির গড় গভীরতা প্রায় ১২ মিটার। রাইনোসরাস লেকের নামের পেছনেও আছে একটি অদ্ভুত গল্প । স্থানীয়দের মধ্যে অনেকে বলেন, এক সন্ন্যাসী গণ্ডারের পিঠে চড়ে শুঝেং ভ্যালির আশেপাশে ভ্রমণ করছিলেন। এখানকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি এতটাই বেখেয়ালি হয়ে পড়েন যে, গণ্ডারটিকে নিয়ে সোজা হ্রদের ভেতরে ঢুকে যান। সেই থেকে এর নাম হয় রাইনোসরাস লেক।

নুয়ারিলাং জলপ্রপাত

জিউঝাইগো ভ্যালির পথে হাঁটতে হাঁটতে সামনেই দেখা যাবে বিশাল নুয়ারিলাং জলপ্রপাত। জেচাওয়া, রিজে আর শুঝেং এই তিন উপত্যকার মিলনস্থলে এই জলপ্রপাতটির অবস্থান। এই প্রবল স্রোতকে তিব্বতি ভাষায় ডাকা হয় “নুয়ারিলাং”, যার মানে পুরুষ, দেবতা কিংবা মহান শক্তি। নামের মতোই এটি সত্যিই এক চমৎকার ও বিশাল জলপ্রপাত। সকালে যখন সূর্যের আলো ফোঁটে, তখন এই জলপ্রপাতের পানির ভেতর রঙধনু ঝলমল করে ওঠে। আর এসময় পুরো দৃশ্যপট দেখে মনে হবে যেন কোন শিল্পীর আঁকা ছবি দেখছি! 

টাইগার লেক

এই জলপ্রপাতের পাশেই রয়েছে রহস্যময় টাইগার লেক। এখানে দাঁড়ালেই শুনতে পাবেন বজ্রধ্বনির মতো পানির শব্দ। শরৎকালে এর প্রাকৃতিক দৃশ্য হয়ে ওঠে একেবারে চোখ ধাঁধানো। এ সময় এখানকার গাছগুলো রঙিন বর্ণ ধারণ করে। রঙিন গাছগুলো যখন পানিতে প্রতিফলিত হয়, তখন মনে হয় যেন হ্রদের ওপর বাঘের গায়ের মতো ডোরা-কাটা নকশা ভেসে ওঠেছে। বিচিত্র এই দৃশ্যের জন্য এর নাম হয়েছে টাইগার লেক। প্রকৃতির এমন অভিনব খেলা দেখে যে কেউই অবাক হতে বাধ্য হবেন।

রাইনোসরাস লেক, টাইগার লেক, নুয়ারিলাং জলপ্রপাত

শুঝেং জলপ্রপাত

টাইগার লেক থেকে আরেকটু এগোলেই আপনি পৌঁছে যাবেন শুঝেং গ্রামে। জিউঝাইগোর নয়টি তিব্বতি গ্রামের মধ্যে একটি হল এই শুঝেং গ্রাম। পাহাড় ঘেরা এই গ্রামে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়বে রঙিন প্রার্থনা পতাকা আর সারি সারি ছোট্ট দোকান। এখানে চাইলেই কোনো ঐতিহ্যবাহী তিব্বতি বাড়িতে ঢুকে একটু খানি সময় কাটানো যায়, পাশাপাশি স্থানীয় গরম গরম ইয়াক বাটার চায়ের স্বাদও নেওয়া যেতে পারে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতির এই মিশ্রণ ভ্রমণকে করে তুলতে পারে আরও স্মরণীয়।

শুঝেং গ্রামের কাছে, রাস্তার পাশেই দেখা যাবে শুঝেং জলপ্রপাত। এটি জিউঝাইগো-এর চারটি বড় জলপ্রপাতের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। যদিও আকারে ছোট, তবুও এটি পর্যটকদের মনে গভীর ছাপ ফেলে। এই জলপ্রপাতের পানির প্রবাহ গাছের ফাঁক দিয়ে হাজারো ছোট ছোট স্রোতে বিভক্ত হয়ে পরে একত্রিত হয় এবং তৈরি করে মনোমুগ্ধকর জলধারা। শুঝেং গ্রাম ঘুরে আসার সময় একবার গিয়ে এই জলপ্রপাতটি দেখে আসতে কেউই ভোলেন না।

স্লিপিং ড্রাগন লেক

এবার একটি অদ্ভুত লেকের নাম বলি। এই লেকের নামটি হলো স্লিপিং ড্রাগন লেক। শুনে মনে হচ্ছে লেকের ভেতর সত্যিই ড্রাগন ঘুমিয়ে আছে তাই না? নামটি অদ্ভুত ও রহস্যময় শোনালেও  ব্যাপারটি এমন নয়। আসলে , প্রায় ২০ মিটার গভীর এই হ্রদের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় এক ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের বাঁধ, যার আকৃতি অনেকটা শুয়ে থাকা ড্রাগনের মতো। মনে হবে যেন পানির ভেতর আস্ত একটা ড্রাগন ঘুমিয়ে আছে। 

রিড লেক

এর থেকে কিছুটা এগোলে চোখে পড়বে একেবারে ভিন্ন সৌন্দর্যের দৃশ্য। সেটি হচ্ছে রিড লেক। এটি প্রায় ১৩৭৫ মিটার লম্বা একটি বিস্তীর্ণ জলাভূমি, চারপাশ ভরে আছে লম্বা লম্বা রিড ঘাসে। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে এক সরু খাল, যাকে সবাই ডাকে “জেড রিবন” বা পান্নার ফিতা নামে। এ নিয়ে আবার স্থানীয়দের  মধ্যে একটি লোক কথার প্রচলন আছে। তারা বিশ্বাস করেন, এটি আসলে এক দেবীর কোমরের ফিতা থেকে সৃষ্ট লেক। শরৎ এলে যখন রিড ঘাস সোনালি রঙে ঝলমল করে ওঠে, আর তার বুক চিরে সেই নীলাভ সবুজ পান্নার মতো খাল বয়ে যায়, তখন দৃশ্যটা দেখে মনে হবে যেন স্বপ্নের কোনো ছবির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন।

বনসাই শোল

এরপর ভ্যালিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই আপনার সামনে হাজির হবে জিউঝাইগোয়ের এক অনন্য বিস্ময় বনসাই শোল। দেখতে পাবেন হাতির দাঁতের মতো সাদা পাথরের ওপর নানা গাছপালা গজিয়ে উঠেছে। এগুলো সরাসরি পানির ভেতর থেকেই শেকড় টেনে পুষ্টি সংগ্রহ করছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন পানির ভেতর ছোট ছোট বনসাই গাছ সাজানো আছে। প্রকৃতির হাতে তৈরি এই জীবন্ত বনসাই বাগান ভ্রমণকারীদের জন্য যেন এক স্বর্গীয় অভ্যর্থনা।

শুঝেং জলপ্রপাত, স্লিপিং ড্রাগন লেক, রিড লেক, বনসাই শোল

জেচাওয়া ভ্যালি

শুঝেং ভ্যালি ঘোরার পর আপনার পরবর্তী গন্তব্য হবে জেচাওয়া ভ্যালি। এটি জিউঝাইগোর  তিনটি উপত্যকার মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ এবং সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত উপত্যকা। জেচাওয়া ভ্যালির সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানের কথা বললে প্রথমেই মাথায় আসে লং লেক এর নাম। জিউঝাইগো ভ্যালির জেচাওয়া উপত্যকার মাথায় অবস্থান করছে বিখ্যাত লং লেক। এটি  চাঙহাই লেক নামেও পরিচিত। এটি জিউঝাইগো-এর সবচেয়ে উঁচু, সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে গভীর হ্রদ। যার শান্ত পানিতে পাহাড়ের প্রতিবিম্ব এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরি করে। 

এ লেকের বিশেষত্ব হলো চারপাশে যতই ঝড়-ঝঞ্ঝা হোক না কেন, এখানে বর্ষাকালে জলস্তর হঠাৎ বেড়ে যায় না, আবার শীতে বা গ্রীষ্মে কখনো শুকিয়েও যায় না। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, হ্রদের কোনো দৃশ্যমান জলপ্রবাহ নেই। না আছে কোনো নদীর সঙ্গে সংযোগ, আবার না আছে কোনো স্পষ্ট জলনিষ্কাশন পথ। মনে হয় যেন প্রকৃতি এখানে এক গোপন জলাধারের রহস্য লুকিয়ে রেখেছে। স্থানীয়রা বলে থাকেন,  মাঝে মাঝে নাকি এই হ্রদে রহস্যময় দানব বা অজানা জীবের দেখা মেলে। এ ধরনের পৌরাণিক গল্পগুলো চাঙহাই লেকের রহস্যময়তাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

ফাইভ কালার পুল 

জিউঝাইগো ভ্যালিতে পর্যটকেরা আসবেন আর ফাইভ কালার পুল ঘুরে যাবেন না; এটা কিন্তু অসম্ভব! লং লেক থেকে ভূগর্ভস্থ জলের প্রবাহে জন্ম নিয়েছে অনন্য হ্রদ ‘ফাইভ কালার পুল’। এটি আবার  “জেড পুল” নামেও পরিচিত। নামের মতোই এর জল পাঁচ রঙে ঝলমল করে ওঠে। সবুজ, নীল, ফিরোজা, হালকা হলুদ আর গাঢ় নীলের মিশ্রণ এই হ্রদকে বানিয়েছে জিউঝাইগোর সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর রত্নগুলোর একটি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, আকারে ছোট ও গভীরতায় সামান্য হলেও, এর জল বিশ্বের অন্যতম স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল। হ্রদের ভেতরের রঙিন খনিজ, উদ্ভিদ আর পাথরের কারণে পানিতে সূর্যের আলো পড়লে সৃষ্টি হয় এক যাদুকরী দৃশ্য। গ্রীষ্মে এর সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল হয়। তিব্বতীয় লোককথা অনুযায়ী, এই হ্রদ একসময় দেবতাদের ধ্যানের স্থান ছিল, যেখানে পানির রঙ পরিবর্তন হতো তাদের উপস্থিতির প্রভাবে। তাই স্থানীয়রা একে সৌভাগ্য ও শান্তির প্রতীক  মনে করে।

ফাইভ কালার পুল

 

রিজে ভ্যালি

যদি প্রশ্ন করেন জিউঝাইগো ভ্যালির সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান কোনটি, তবে উত্তর আসবে রিজে ভ্যালি। নিঃসন্দেহে এটি জিউঝাইগোর সবচেয়ে রঙিন আর মনোমুগ্ধকর জায়গা। এখানে রয়েছে অসংখ্য বর্ণিল হ্রদ, আকাশছোঁয়া জলপ্রপাত আর সবুজে মোড়া ঘন বনভূমি। প্রকৃতির বুকে যেন এক রঙের রাজ্য, যা আপনাকে পুরোটা সময় জুড়ে মুগ্ধ করে রাখবে । তাই আপনার জিউঝাইগো ভ্রমণের সর্বশেষ সংযোজন হতে পারে এই রিজে ভ্যালি।

প্রাইমিভাল ফরেস্ট

এই ভ্যালিতে ঘুরতে গেলে প্রথমেই চোখে পড়বে প্রাইমিভাল ফরেস্ট। এটি একেবারেই আদিম অরণ্য, যেখানে বিশাল বিশাল ফার আর স্প্রুস গাছ শত শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে ।  

বন থেকে সামনের দিকে চোখ মেললেই দেখবেন, ৫০০ মিটার উঁচু তরবারির মতো সোজা উঠে যাওয়া ‘সোর্ড রক’। আকাশকে ছুঁতে চাওয়া এই সোর্ড রক যেন পাহাড়ের বুকে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল তলোয়ারের মতো করে করে। এর পাশেই আবার দেখবেন পাহাড়ের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে এক ঝর্ণাধারা। দেখতে মনে হবে যেন আকাশ থেকে সাদা সুতোর মতো করে মেঘ ঝরে পড়ছে। এ স্বচ্ছ ঝর্ণাধারা নাম হচ্ছে সাসপেন্ডেড স্প্রিং। স্থানীয়রা এ পানিকে মনে করেন দেবী সেমোর চোখের জল। তাদের কাছে এ নিয়ে বেশ মজার গল্পও শুনতে পাবেন। স্থানীয়রা বিশ্বাস করে থাকেন, দেবী সেমো তাঁর প্রিয় দেবতা দাগেকে খুঁজতে গিয়ে কেঁদেছিলেন, আর তার অশ্রুই নেমে এসেছে এই ঝর্ণা হয়ে।

যে কেউ চায়লেই এখানকার কোন এক শান্ত, সুবাসিত,মনমুগ্ধকর জলাভূমির পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারেন। তবে এর জন্য একটি উপযুক্ত স্থান হবে ফাংচাও সি বা “ফ্র্যাগরান্ট গ্রাস সি”। নাম শুনে কি ভাবছেন এই জলাভূমি থেকে সুগন্ধ ছড়ায়? ঠিকই ভাবছেন; এই হ্রদের নাম এসেছে পানির উপর ভাসমান বিশেষ জাতের সুবাসিত ঘাস থেকে। এমন সুবাসিত মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে চাইলে অবশ্যই বর্ষাকালে জিউঝাইগো ভ্যালি ঘুরতে যেতে হবে। কারণ বর্ষাকালেই ফাংচাও সি এমন স্বপ্নময় দৃশ্য তৈরি করে। 

এছাড়া, ফাংচাও সি ঘিরে সারা বছর ভেসে বেড়ায় নানা জলপাখি, এবং মাঝেমধ্যে দেখা যায় সাপানু বা ছোট জলজ প্রাণীও। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাণিজগত ফটোগ্রাফি প্রেমী পর্যটকদের জন্য হতে পারে এক আদর্শ গন্তব্য। 

ফটোগ্রাফি প্রেমী পর্যটকদের কথা যখন বলছি, তখন আরেকটি মনোরম ফটোজেনিক জায়গার নাম না বললেই না। আর সেটি হচ্ছে সোয়ান লেক। এখানে প্রতিবছর ভিড় জমানো অসংখ্য অভিবাসী রাজহাঁসের জন্য এর নামকরণ করা হয়েছে  সোয়ান লেক। এর সবচেয়ে বিশেষ দিক হল, এখানে শীতকালে রাজহাঁসরা দল বেঁধে আসে, এবং তাদের সংখ্যা কখনো কয়েকশো, আবার কখনো হাজারও হতে পারে। হ্রদের পরিষ্কার পানি, স্বচ্ছ পানিতে পাহাড়ের প্রতিফলন এবং রাজহাঁসদের সরল চলাচল একসাথে মিলিয়ে যে দৃশ্য তৈরি করে তা আসলেই ভোলার মত নয়।

প্রাইমাল ফরেস্ট

পান্ডা লেক ও পান্ডা ওয়াটারফল

এরপর ঘুরে আসা যেতে পারে পান্ডা লেক ও পান্ডা ওয়াটারফল-এ। এই হ্রদটি ঘন বাঁশবনে ঘেরা। একসময় লেকটি জায়ান্ট পান্ডাদের প্রিয় পানির উৎস ছিল। হ্রদের পানি কখনো গাঢ় নীল, কখনো সবুজের আভা ছড়ায়, এবং সূর্যের আলোতে ঝলমল করে। এই হ্রদ শুধু পানির জন্যই বিখ্যাত নয় বরং এখান থেকেই শুরু হয় পান্ডা ওয়াটারফল। এই জলপ্রপাতের পানি খাড়া পাহাড় বেয়ে নেমে আসার সময় কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়, আবার আশ্চর্যজনক ভাবে মিলিত হয়ে বিশাল গর্জন তোলে। সামনে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখলে মনে হবে, প্রকৃতি যেন এখানে তার সমস্ত শক্তি, রহস্য ও সৌন্দর্য একসাথে ঢেলে দিয়েছে। 

অ্যারো ব্যাম্বু লেক

পান্ডা লেক ও পান্ডা ওয়াটারফল দেখার পর এবার চলে যেতে হবে অ্যারো ব্যাম্বু লেকে। এই হ্রদ এলাকাটি  বিশেষত ঘন বাঁশঝাড়ের জন্য পরিচিত। যা পান্ডাদের প্রিয় খাদ্য। প্রায় ১,৭০,০০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই অগভীর হ্রদের গভীরতা মাত্র ৬ মিটার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো বটেই, এর সাংস্কৃতিক গুরুত্বও কম নয়। চীনের বিখ্যাত সিনেমা “Hero”-এর কিছু দৃশ্য এখানে ধারণ করা হয়েছিল। তাই এটি একই সাথে ফটোগ্রাফি ও সিনেমা প্রেমীদের জন্যও হতে পারে একটি আকর্ষণীয় জায়গা।

ফাইভ ফ্লাওয়ারস সি

অন্যদিকে, জিউঝাইগো ভ্যালির সবচেয়ে জাদুকরী দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি হলো ফাইভ ফ্লাওয়ারস সি। নামের মতোই, হ্রদের পানি এখানে পাঁচটি রঙে ঝলমল করে; কালো-সবুজ, নীল, পান্না সবুজ, হলুদ এবং আরও কিছু সূক্ষ্ম ছায়া। এর কারণ হলো হ্রদের পানির ভেতরে মিশে থাকা নানা খনিজ পদার্থ ও শৈবাল।দূর থেকে দেখলে মনে করবেন যেন ময়ূরের রঙিন পালক পানির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে হ্রদের পাশে বয়ে যাওয়া নদীর নাম দেওয়া হয়েছে পিকক রিভারওয়ে। বিশেষ করে শরৎকালে আশেপাশের পাহাড়ি গাছপালা যখন লাল, হলুদ ও কমলার রঙ ধারণ করে, তখন এই দৃশ্য আরো জীবন্ত হয়ে ওঠে। 

মিরর লেক

ভ্রমণের শেষ প্রহরে এসে অপেক্ষা করছে জিউঝাইগোর সবচেয়ে স্বপ্নময় স্পট;  মিরর লেক। এর স্বচ্ছ জলে আশেপাশের পাহাড়, অরণ্য, আকাশ এমনকি মেঘও প্রতিফলিত হয় নিখুঁতভাবে। ভোরবেলার কুয়াশা আর সন্ধ্যার সোনালি আলোয় লেকটির দৃশ্য হয়ে ওঠে একেবারেই জাদুকরী। যেন প্রকৃতি নিজেই থেমে গিয়ে নিজের প্রতিকৃতি এঁকেছে। 

শুঝেং জলপ্রপাত, স্লিপিং ড্রাগন লেক, রিড লেক, বনসাই শোল

জিউঝাইগো ভ্যালির  প্রতিটি স্থান সত্যিই মনোমুগ্ধকর। এখানে প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য, স্থানীয় লোককথা এবং ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাস একত্রে মিলিয়ে ভ্যালিটিকে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছে। এই স্বতন্ত্র পরিচয়ই পর্যটকদের প্রতি জিউঝাইগো ভ্যালির অদম্য আকর্ষণ তৈরি করছে।জিউঝাইগো ভ্যালি এর সৌন্দর্য, রহস্য এবং প্রাকৃতিক জাদুতে মুগ্ধ করে যাক সারা বিশ্বের পর্যটকদের, এই কামনায় শেষ করছি বিশ্ব প্রান্তরের আজকের পর্ব ।

তথ্যসূত্র-

https://www.topchinatravel.com/china-attractions/jiuzhaigou-scenic-area.htm

https://www.jiyobangla.com/bn/news/chinese-heaven-jiuzhaigou

https://archive.roar.media/bangla/main/world/jiuzhaigou-valley

https://www.chinadiscovery.com/tour-jiuzhaigou/what-to-see-in-jiuzhaigou.html

 

Related posts

যেভাবে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লো পারমাণবিক অস্ত্র

ম্যান্ডেলা ইফেক্ট – প্যারালাল ইউনিভার্সের প্রমাণ নাকি মস্তিষ্কের ধোঁকা

ইসরাত জাহান ইরা

ঢাকার আকাশে কাকের অভাব: কোথায় গেল এই চেনা পাখি?

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More