ধুমপান মৃত্যু ঘটায় কথাটার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। তবে খাবারও যে হতে পারে মৃত্যুর কারণ তা কি কখনো শুনেছেন?
হ্যাঁ, এটি সত্যিই ঘটছে, আর তা অন্য কোথাও নয়, পৃথিবীর সবথেকে উন্নত দেশ আমেরিকার ম্যাকঅ্যালেন শহরে! শুধু তাই নয়, খুব শিগগিরই এটি মৃত্যুর কারণ হিসেবে ধূমপানকেও ছাড়িয়ে যাবে। কারণ, খাবারের কারণেই মানুষ ভুগছে স্থূলতা নামক এক ভয়াবহ রোগে।
আজকের লেখায় আমরা বোঝার চেষ্টা করব কেন ম্যাকঅ্যালেনে স্থূলতা বেড়েই চলেছে? এবং এর পেছনে কোন গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে কিনা!
স্থূলতার শহর ম্যাকঅ্যালেন
টেক্সাসের দক্ষিণ সীমান্ত ঘেষা শহর ম্যাকঅ্যালেন। অন্যান্য শহরের মতোই ম্যাকঅ্যালেন একেবারেই সাধারণ একটি শহর। কিন্তু এর বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা আজ বিশ্বের নজর কেড়েছে। শুনে অবাক হবেন যে, এখানে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় অর্ধেকই স্থূল বা অতিরিক্ত ওজনের সমস্যায় ভুগছেন। এর ফলে ডায়াবেটিকস, হৃদরোগ, ক্যানসার এমনকি অকাল মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ছে প্রতিদিন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণে, রিও গ্র্যান্ড ভ্যালি অঞ্চলে অবস্থিত ম্যাকএলান। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯০৪ সালে ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত কৃষক জন ম্যাকঅ্যালেন ও জেমস ম্যাকঅ্যালেনের নামে শহরটির নামকরণ করা হয়। প্রাথমিকভাবে এটি ছিল একটি কৃষিভিত্তিক বসতি। বিশেষ করে তুলা ও সাইট্রাস ফল চাষের জন্য এই এলাকা সর্বাধিক পরিচিত ছিল।
ম্যাকএলান শহরটি আয়তনে প্রায় ১২০ বর্গকিলোমিটার এবং এর জনসংখ্যা ১ লক্ষ ৪৮ হাজারেরও বেশি, যা এটিকে টেক্সাসের অন্যতম ব্যস্ত শহরে পরিণত করেছে। কিন্তু এই জনসংখ্যার বেশিরভাগই ভুগছে স্থূলতা নামক এক ভয়াবহ রোগে। শহরটির প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের প্রায় ৪৫ শতাংশই স্থূলকায় বা মোটা। এছাড়াও, ৩১ শতাংশ মানুষ অতিরিক্ত ওজনের স্বীকার।
আরও ভয়াবহ বিষয় হলো, শুধু প্রাপ্তবয়স্করাই নয়, ম্যাকএলান শহরের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে স্থূলতার হার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং শিশুদের মধ্যে পঞ্চম সর্বোচ্চ। অর্থাৎ, সব বয়সী মানুষের মধ্যেই এই শহরে ওজনজনিত সমস্যার প্রকোপ স্পষ্ট। আর একারণেই শহরটিও পরিচিতি লাভ করছে স্থূলদের শহর হিসেবে।
ম্যাকএলানে স্থূলতা এত বেশির কারণ
এখন প্রশ্ন হলো, কেন এই শহরে স্থূলতা এত বেশি? এ শহরের মানুষদের দৈনন্দিন জীবনের দিকে তাকালে বোঝা যায় কেন মোটা হওয়া এখানে এতটা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানকার দোকানগুলোতে গেলে দেখতে পাবেন ৭০ শতাংশেরও বেশি খাবারই আল্ট্রা-প্রসেসড। অর্থাৎ এমন খাবার যা নানা রাসায়নিক, চিনি, লবণ ও কৃত্রিম উপাদানে ভরা। যেমন ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল, প্যাকেটজাত বিস্কুট, কোলা বা সফট ড্রিংক, ফ্রোজেন পিজ্জা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ইত্যাদি। এ খাবারগুলো পেট ভরায় ঠিকই কিন্তু এর পেছনে ভয়াবহ প্রভাব রেখে যায়।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, এই খাবার আসক্তি তৈরি করে। অর্থাৎ, এগুলো একবার খেলে আবার খেতে ইচ্ছে করে, আর সেই চক্র থেকে বের হওয়াটাও বেশ কঠিন। এর প্রভাব অনেকটা ধূমপান বা মদ্যপানের মতোই। যেমন- সিগারেট বা অ্যালকোহল মানুষকে বারবার আকৃষ্ট করে, ঠিক তেমনি এই খাবারগুলোও অদৃশ্যভাবে মানুষকে বেঁধে ফেলে।
ম্যাকঅ্যালেনে অতিরিক্ত স্থূলতার প্রথম ও প্রধান কারণ হলো সস্তা ফাস্ট ফুড। শহরের যেকোনো এলাকায় গেলেই হাতের কাছেই ছয়-সাতটা ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্ট পাওয়া যায়। বার্গার, পিজা, ফ্রাইড চিকেন সবকিছুই সেখানে মিনিটের মধ্যে পাওয়া যায়, আর দামের দিক থেকেও বেশ সস্তা। কিন্তু এর বিপরীতে, যদি স্বাস্থ্যকর খাবার যেমন শাকসবজি বা ফল কিনতে চান, সেক্ষেত্রে খরচ গুনতে হয় কয়েকগুণ বেশি।
এর দ্বিতীয় বড় কারণ হলো দারিদ্র্য। ম্যাকঅ্যালেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ মানুষ দারিদ্র্যের নিচে জীবন কাটান, যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ শহরের অনেক পরিবারই প্রতিদিন টাকার হিসাব কষে চলতে বাধ্য। আর এই অর্থনৈতিক চাপে পড়েই তারা স্বাস্থ্যকর খাবারের কথা চিন্তা করতে পারেন না। ফলে সাধারণ পরিবারগুলো যখন মাসের শেষে টাকার টানাটানিতে পড়ে, তখন তাদের সামনে একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায় ‘২৫ সেন্টের চিকেন উইংস বা ৫০ সেন্টের টাকো’।
সমস্যাটা যে শুধু দামের তা নয়, বরং অবকাঠামোরও। ম্যাকঅ্যালেনের আবহাওয়া সারা বছরই এত গরম থাকে যে বাইরে হাঁটা বা ব্যায়াম করা প্রায় অসম্ভব। ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপরে তাপমাত্রায় কেউ-ই চাইলেও রাস্তায় নেমে হাঁটতে বা দৌড়াতে পারবে না। এর সঙ্গে যোগ হয় শহর পরিকল্পনার দুর্বলতা। প্রতিটি জায়গায় যেতে হলে গাড়ি ছাড়া উপায় নেই। রাস্তা-ঘাট, বাজার কিংবা অফিস সবকিছুই গাড়ি নির্ভর করে তৈরি করা হয়েছে।
অন্যদিকে যদি আমরা প্যারিস বা ইউরোপের অন্য শহরগুলোর দিকে তাকাই, সেখানে হাঁটাচলাই স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অংশ। সেখানে দেখবেন মানুষ প্রায়শই পায়ে হেঁটে কর্মস্থল বা বন্ধুদের বাড়ি ঘুরতে যায়। কিন্তু ম্যাকঅ্যালেনে সেই সুযোগ নেই। ফলে মানুষ চাইলেও শরীরচর্চা বা স্বাভাবিক হাঁটা-চলা করার পরিবেশ পায় না।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো আমেরিকার স্কুল সিস্টেম। বাচ্চারা যখন স্কুলে যায়, তখন তারা বিনামূল্যে যে খাবারগুলো পায়, সেগুলো শুনলে হয়তো অনেকেরই চোখ কপালে উঠবে। দিনের পর দিন তাদের দেওয়া হয় পিজ্জা, বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বা চিকেন নাগেটসের মতো তেলেভাজা ও প্রক্রিয়াজাত খাবার। এর মানে হচ্ছে, ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের খাবারের পছন্দ তৈরি হচ্ছে জাঙ্ক ফুড কেন্দ্রিক। আর যখন তারা বড় হয়, তখন এই অভ্যাস ছাড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে যদি আমরা জাপানের দিকে তাকাই, সেখানে স্কুলে প্রতিদিনই স্বাস্থ্যকর, ভারসাম্যপূর্ণ খাবার দেওয়া হয়। শাকসবজি, মাছ, ভাত, স্যুপ সবকিছু থাকে ব্যালান্সড। ফলে বাচ্চারা ছোটবেলা থেকেই সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলে, যা তাদের ভবিষ্যৎকে রোগমুক্ত রাখে। কিন্তু আমেরিকার ক্ষেত্রে এর উল্টোটা হচ্ছে। এখানে শিশুদের প্রথমেই প্রসেসড খাবারের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, আর পরিণত বয়সে তারা স্থূলতা, ডায়াবেটিকস কিংবা হৃদরোগের মতো জটিল রোগে ভুগছে।
গভীর ষড়যন্ত্র
তবে, শুধুই কি পরিবেশগত সমস্যা, নাকি এই স্থূলতার হার বাড়ানোর পেছনে রয়েছে কোন গভীর ষড়যন্ত্র? ২০১১ সালে আমেরিকার কংগ্রেসের একটি সিদ্ধান্ত শুনলে সবাই অবাক হবেন। তারা মাত্র দুই টেবিল চামচ টমেটো পেস্টকে শাকসবজির অংশ হিসেবে গণনা করার অনুমতি দেয়। অর্থাৎ, কোন খাবারের সাথে যদি টোমেতো কেচাপ থাকে তাহলেই তা সবজি বা স্বাস্থ্যকর হিসেবে খাবার হিসেবে গণ্য হবে।
আর এভাবেই ম্যাকএলান শিশুদের প্লেটে প্রতিদিন পিজ্জার স্লাইস রাখা হয়, আর আইন অনুযায়ী তা হয়ে যায় স্বাস্থ্যকর সবজি। এই ভয়াবহ আইনের পেছনে কাজ করেছে খাদ্য শিল্পের ব্যবসায়ীদের লবি এবং টাকা। এভাবেই শহরের প্রতিটি শিশুর শরীরে যাচ্ছে প্রক্রিয়াজাত খাবার, যা শুধু পেট ভরাচ্ছে না, বরং ভবিষ্যতে স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের মতো সমস্যা তৈরি করছে। এই আইন যেন শিশুদের স্বাস্থ্যের ওপর ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলার দরজা খুলে দিয়েছে।
তবে সব কিছু সত্ত্বেও পরিবর্তনের আশা আছে। যেমন ধীরে ধীরে আমেরিকান জনগণ তথা ম্যাক এলান শহরের জনগণ সচেতন হচ্ছে। ভোক্তাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে ওয়ালমার্টের মতো বড় দোকানেও অর্গানিক খাবার আসতে শুরু করেছে। যদিও এ সমস্যার সমাধান একদিনে হবে না। তবে শিক্ষা, সচেতনতা, আর নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এগোনো সম্ভব।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষকে জানানো যে তারা একা নয়। যারা স্থূলতার সমস্যায় ভুগছেন, তাদের কেউই দোষী নন। তারা আসলে এমন এক সিস্টেমের শিকার, যা তাদের ছোটবেলা থেকেই প্রসেসড খাবারের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমরা চাই, ম্যাকঅ্যালেন শহরটি শুধু স্থূলতার জন্য পরিচিত না হয়ে, বরং সুস্থ শরীরের মানুষের জন্যও একটি উদাহরণ হয়ে উঠুক। এই কামনায় শেষ করছি বিশ্ব প্রান্তরের আজকের পর্ব ।
তথ্যসূত্র-
- https://www.youtube.com/watch?v=t8dkUevKUmw
- https://www.youtube.com/watch?v=RazNHIreQ-E
- https://knue.com/texas-obesity-study-mcallen/
- https://timesofindia.indiatimes.com/life-style/health-fitness/health-news/is-america-heading-to-an-obesity-epidemic-these-us-cities-have-the-most-obese-people/articleshow/120253464.cms