Image default
রহস্য রোমাঞ্চ

যেভাবে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লো পারমাণবিক অস্ত্র

আইনস্টাইন সেই চিঠি না লিখলে হয়তো, পৃথিবীর ইতিহাস অন্যরকম হতো! 

আমরা এমন এক সংঘাতময় পৃথিবীতে বাস করি যেখানে আমাদের আশপাশের দেশগুলো পারমাণবিক বোমা নামক এক ভয়ংকর মরণাস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, যেটি কিনা মুহূর্তের মধ্যে একটা গোটা শহর, এমনকি একটি দেশকে পর্যন্ত পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিতে পারে। কিন্তু কখনো কী ভেবে দেখেছেন, যে ক্ষমতা একটা শহরকে চোখের পলকে ভষ্ম করে দিতে পারে, সেই ক্ষমতা অর্জন করার জন্য সব দেশ কেন এতটা মরিয়া হয়ে ওঠে? কেন তারা নিজেদের অর্থনীতি, কোটি কোটি মানুষের জীবন, এমনকি পুরো পৃথিবীর ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মুখে ফেলে এই ভয়ঙ্কর অস্ত্রের পেছনে ছোটে? 

পারমানবিক অস্ত্রের শুরু 

এই গল্পের শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে, ১৯৪৫ সালের ১৬ই জুলাই। আমেরিকার নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে ভোরের আলো ফোটার ঠিক আগে, পৃথিবীর বুকে প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী, রবার্ট ওপেনহাইমার, সেই আগুন আর মেঘের ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ দেখে উচ্চারণ করেছিলেন প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ভগবদগীতার একটি শ্লোক, “Now I become Death, the destroyer of worlds” অর্থাৎ “আমিই এখন সাক্ষাৎ মৃত্যু, বিশ্ব ধ্বংসকারী।”

দু:খজনক হলেও সত্য, যে পারমাণবিক দৈত্যকে সেদিন বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের বোতল থেকে বের করা হয়েছিল, তাকে আর কখনও ভেতরে ফেরানো যায়নি। কারণ মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরেই, জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকির মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে দেখতে পায়, এই নতুন আবিষ্কারের আসল চেহারা। পারমাণবিক বোমার ধ্বংসের ক্ষমতাই ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি। এই অস্ত্রই নির্ধারণ করে দেয় কার হাতে রয়েছে বিশ্বকে শাসন করার অধিকার। 

কিন্তু কীভাবে মাত্র একটি দেশ থেকে এই পারমাণবিক শক্তি ছড়িয়ে পড়লো আরও আটটি দেশে?

আইন্সটাইনের চিঠি- পারমানবিক ছড়িয়ে পড়ার শুরু

সবকিছুর শুরু হয়েছিল একটি চিঠি দিয়ে। ১৯৩৯ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে, বিখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে একটা চিঠি লিখে সতর্ক করেন যে, হিটলারের নাৎসি জার্মানি হয়তো পারমাণবিক বোমা তৈরির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এই একটা চিঠিই জন্ম দেয় ইতিহাসের সবচেয়ে গোপন, সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং সবচেয়ে ভয়ংকর এক প্রজেক্ট যার নাম– “ম্যানহাটন প্রজেক্ট”। 

ম্যানহাটন প্রজেক্টের এর অফিসে কর্মরত বিজ্ঞানীরা

আমেরিকায় পারমানবিক বোমা

আইনস্টাইনের এই চিঠি আসার পর আমেরিকার সেরা বিজ্ঞানীরা দিনরাত এক করে কাজ শুরু করেন। তাদের মনে ছিল একটাই ভয় —যদি হিটলার তাদের আগে এই বোমা বানিয়ে ফেলেন, তাহলে মানব সভ্যতা আর টিকবে না। মূলত এই ভয় থেকেই জন্ম নেয় অ্যাটম বোমা।

১৯৪৫ সালে আমেরিকা যখন বিশ্বের প্রথম এবং একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হলো, তারা ভেবেছিল এই ক্ষমতা তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য দেবে। কিন্তু সেখানেই আমেরিকার মস্ত বড় একটা ভুল করে বসে। দেশটি ভুলে গিয়েছিলো, কোন জ্ঞানকেই কখনো আটকে রাখা যায় না। যে জ্ঞানের মাধ্যমে ‘’পারমানবিক বোমা’ নামের বিষবৃক্ষের জন্ম হয়েছে, তার বীজ আজ হোক বা কাল, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বেই।

গুপ্তচরের হাত ধরে সোভিয়েতে পারমানবিক বোমা

সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা, ক্লাউস ফুকসের মতো কয়েকজন গুপ্তচরের সাহায্য নিয়ে, অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাজ করে যান। ফুকস ছিলেন ম্যানহাটন প্রজেক্টের একজন বিজ্ঞানী, যিনি গোপনে পারমাণবিক বোমার নকশা মস্কোতে পাচার করে দিয়েছিলেন। অবশেষে, ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রথম পারমাণবিক বোমার সফল পরীক্ষা চালায়। 

সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সাথে সাথেই পৃথিবীতে শুরু হয়ে যায় ধ্বংসের এক ভয়ংকর প্রতিযোগিতা। কোন দেশ কত সুনিপুণভাবে আরেক দেশকে ধ্বংস করার এই অস্ত্র বানাতে পারে, তারই লড়াই যেন চলছিলো পৃথিবী জুড়ে। এর মধ্যে দিয়েই পৃথিবী প্রবেশ করে “Mutually Assured Destruction”(মিউচুয়ালি এস্যুয়ার্ড ডিস্ট্রাকশন) বা MAD-এর এক ভয়ঙ্কর যুগে। 

পারমানবিক বোমার নকশা

সোজা কথায়, এর মানে হলো—দুই পক্ষের কাছেই এত পরিমাণ ভয়ংকর বোমা আছে যে, একজন আক্রমণ করলে অন্যজন পাল্টা আক্রমণে তাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারবে। অর্থাৎ যদি যুদ্ধ শুরু হয়, কেউ জিতবে না, বরং সবাই ধ্বংস হবে। তবে এই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ভয়ই মূলত পরবর্তী কয়েক দশক ধরে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর মধ্যকার সরাসরি যুদ্ধকে ঠেকিয়ে রেখেছিল।

কিন্তু তাই বলে কী পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি বন্ধ থাকবে? তা তো নয়ই বরং ধ্বংসের এই খেলায় যোগ দেয় আরও কয়েকটি দেশ, কারণ ততদিনে তারা বুঝে গিয়েছে বিশ্বে নিজেদের শক্তি আর ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারমাণবিক অস্ত্রের কোন বিকল্প নেই।

সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক অস্ত্র পাওয়ার পর যুক্তরাজ্য সে তালিকায় যুক্ত হয়। এর পেছনের কারণটি ছিল আরও নাটকীয়। 

যুক্তরাজ্যের পরমানবিক শক্তি ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতা 

ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন প্রজেক্টে কাজ করলেও, যুদ্ধের পর আমেরিকা তাদের সাথে এই প্রযুক্তি বিনিময় করতে অস্বীকার করে। যুক্তরাষ্ট্রের এই বিশ্বাসঘাতকতা ছিল ব্রিটেনের জন্য এক বিরাট অপমান। যে সাম্রাজ্য একসময় সারা বিশ্বকে শাসন করে বেড়িয়েছে, তারা আমেরিকার ছোট ভাই হয়ে থাকবে? এই বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি যুক্তরাজ্য। তাই নিজেদের হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি নিজেদের ক্ষমতা আর নিরাপত্তাকে আরও জোরদার করতে, ব্রিটেন ১৯৫২ সালে তাদের নিজস্ব পারমাণবিক বোমা তৈরি করে।

ফ্রান্সে পারমানবিক শক্তি

তার ঠিক পরেই মঞ্চে আসে ফ্রান্স। তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট চার্লস ডি গল আমেরিকাকে মোটেও বিশ্বাস করতেন না। ১৯৫৬ সালের সুয়েজ খাল নিয়ে সংকটের সময় ব্রিটেন ও ফ্রান্স হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল যে, আমেরিকার সম্মতি ছাড়া তারা বিশ্বে আর কোনো বড় পদক্ষেপ নিতে পারবে না। তাই ফরাসি জাতীয়তাবাদের অহংকার আর কৌশলগত স্বাধীনতার জন্য, ১৯৬০ সালে ফ্রান্স সর্বপ্রথম তাদের নিজস্ব পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করে।

এশিয়ার প্রথম পরমানু শক্তিধর দেশ চীন

রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপ ছাড়িয়ে এবার পারমাণবিক অস্ত্র আসে এশিয়ায়। এশিয়া মহাদেশের সর্বপ্রথম দেশ হিসেবে চীন পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হয়। তবে, এই ক্লাবের পঞ্চম সদস্য হিসেবে চীনের প্রবেশ ঘটে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। ১৯৫০-এর দশকে কোরীয় যুদ্ধে আমেরিকার পারমাণবিক হুমকির মুখে পড়ে চীনের সমাজতান্ত্রিক নেতা মাও সে তুং। এ সময় তিনি বুঝেছিলেন, পরাশক্তিদের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হলে তাদেরও এই অস্ত্র লাগবে।

পারমানবিক অস্ত্র তৈরিতে প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমে সাহায্য করার কথা বললেও, পরবর্তীতে মতাদর্শগত বিরোধের কারণে সেই সাহায্য বন্ধ করে দেয়। কিন্তু প্রগতিশীল চীনারা দমে যায়নি। নিজেদের চেষ্টাতেই তারা ১৯৬৪ সালে পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করে। চীনের জন্য এটা ছিল পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্যকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল।

ইসরায়েলের পরমানবিক বোমা রহস্য

চীনের পর এশিয়ার দ্বিতীয় দেশ হিসেবে সে তালিকায় যোগ হয় ইসরায়েল। যদিও তাদের এই অবস্থান নিয়ে রহস্য দানা বেঁধে আছে। ইসরায়েলের জাতীয় নীতির মূলমন্ত্র ছিল “নেভার এগেইন”। হলোকাস্টের মতো জাতিগত নিধনের ঘটনা যেন ইহুদিদের সাথে আর কখনো না ঘটে, সেজন্য চূড়ান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের কাছে ছিল অপরিহার্য। এছাড়া পশ্চিমা শক্তির মদদপুষ্ট দেশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করাও ছিল পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হওয়ার অন্যতম কারণ। 

সে কারণে ফ্রান্সের সহায়তায় দেশটি নেগেভ মরুভূমির দিমোনায় একটি গোপন পারমাণবিক চুল্লি তৈরি করে। যদিও পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে ইসরায়েল সবসময়ই নীরব ভূমিকা পালন করেছে। পারমাণবিক বোমা আছে কিনা এ বিষয়ট তারা কখনোই এটা স্বীকার বা অস্বীকার কোনটাটাই করে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইসরায়েলের এই অস্পষ্টতার নীতিই তাদের সবচেয়ে বড় কৌশল। কারণ বিশ্বের সবাই জানে, ইসরায়েল নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য কত নিচে নামতে পারে।

ভারতের পারমানবিক অস্ত্র

এবার চলুন মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে যাওয়া যাক দক্ষিণ এশিয়ায়। এখানকার গল্পটা আমাদের, অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই গল্পের সাথে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও জড়িয়ে আছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্র পাওয়ার প্রতিযোগিতায় প্রথমেই নাম লেখায় বাংলাদেশের প্রতিবেশি দেশ ভারত। ১৯৬২ সালে চীনের সাথে সীমান্ত যুদ্ধে হেরে যাওয়ার ঠিক দু’বছর পর, ১৯৬৪ সালে চীন তাদের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করে। চীনের এই সফলতা স্বাভাবিকভাবেই ভারতকে নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। ভারতের দূরদর্শী নেতারা, বিশেষ করে পরমাণু কর্মসূচির জনক ড. হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা বুঝতে পারছিলেন যে, দেশের উত্তর সীমান্তে একটি পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর উপস্থিতির জন্য, ভারতের নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

এই উদ্বেগ আরও তীব্র হয় ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। যখন বাংলাদেশের বিজয় প্রায় নিশ্চিত, আমেরিকা তখন পাকিস্তানকে সমর্থন দিতে বঙ্গোপসাগরে তাদের শক্তিশালী সপ্তম নৌবহর পাঠায়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই ঘটনাকে একটি সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখেন। এই ঘটনাই ভারতকে চূড়ান্তভাবে বুঝিয়ে দেয় যে, পরাশক্তিদের হাত থেকে বাঁচতে হলে নিজেদের পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।

এর ফলস্বরূপ, ১৯৭৪ সালের ১৮ই মে, ভারত রাজস্থানের পোখরান মরুভূমিতে একটি পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়, যার পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছিল “স্মাইলিং বুদ্ধ”। এর মাধ্যমে ভারত বিশ্বকে জানায় যে, এটি ছিল একটি “শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক বিস্ফোরণ”। কিন্তু বিশ্ব এবং বিশেষ করে পাকিস্তান এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করেনি। সবাই বুঝে গিয়েছিল পারমাণবিক ক্লাবে এক নতুন সদস্যের আগমন ঘটেছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্য চিরতরে বদলে গেছে।

রাজস্থানের পোখরান মরুভূমিতে ভারতের পারমানবিক বোমা পরীক্ষা

পাকিস্তানের পারমানবিক বোমা

ভারতের এই পরীক্ষা সরাসরি পারমাণবিক ডমিনো এফেক্ট তৈরি করে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পরাজয় এবং বাংলাদেশ নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম, পাকিস্তানের জন্য ছিল এক বিরাট জাতীয় ট্রমা। এই পরাজয় তাদের বুঝিয়ে দেয় যে, প্রচলিত সামরিক শক্তি দিয়ে ভারতের সাথে পেরে ওঠা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষুব্ধ হয়ে ঘোষণা করেছিলেন, “আমার দেশের মানুষ ঘাস বা লতাপাতা খেয়ে থাকবে, এমনকি ক্ষুধায় মরে গেলেও আমরা আমাদের নিজেদের বোমা বানাবই। যদি ভারতকে বোমা বানাতে হয়, তবে আমাদেরও বানাতে হবে।”

পাকিস্তানের জন্য এটা ছিল ভারতের বিরুদ্ধে টিকে থাকার এক জীবন-মরণ লড়াই। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ডঃ আব্দুল কাদির খানের (এ. কিউ. খান) নেতৃত্বে পাকিস্তান একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল  গোপন কর্মসূচি শুরু করে। আব্দুল কাদির খান নেদারল্যান্ডসের একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্ট থেকে সেন্ট্রিফিউজের নকশা চুরি করে আনেন। পরবর্তীতে চীন ও অন্যান্য দেশের সহায়তায় পাকিস্তান ধীরে ধীরে পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করে। 

অবশেষে, ১৯৯৮ সালে ভারত যখন পোখরানে আবারও একাধিক পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়, তার মাত্র কয়েক সপ্তাহের মাথায় পাকিস্তানও বেলুচিস্তানের চাগাই পাহাড়ে পাল্টা ছয়টি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের সক্ষমতার জানান দেয়। আর এভাবেই দক্ষিণ এশিয়া পরিণত হয় বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক একটি পারমাণবিক হটস্পটে।

উত্তর কোরিয়া- বোমা নয়, টিকে থাকার বীমা

পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে নবম এবং সবচেয়ে নবীন সদস্য হলো উত্তর কোরিয়া।  আমরা সবাই জানি, উত্তর কোরিয়া আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন একটি দেশ যেখানে একনায়কতান্ত্রিক শাসন এখনো টিকে আছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর উত্তর কোরিয়া তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকায় পড়ে যায়। 

পারমানবিক বোমা ও কিম জন উন

এসময় কিম জং উনের দেশ, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন বা লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়। কারণ এই শাসকেরা পশ্চিমা শক্তির কাছে হেরে গিয়ে পারমাণবিক কর্মসূচি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। যার ফলস্বরূপ নিজেদের পতনের পাশাপাশি তাদের দেশকেও পরাধীনতার শিকলে আটকে ফেলে পশ্চিমারা। তাই কিম পরিবার বুঝতে পারে, নিজেদের একচেটিয়া শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার একমাত্র গ্যারান্টি হলো পারমাণবিক বোমা। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তারা তাদের কর্মসূচি চালিয়ে গেছে। তাদের জন্য এই বোমা হলো পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে টিকে থাকার একমাত্র বীমা।

পারমানবিক অস্ত্র সন্দেহে ইরান

পারমাণবিক অস্ত্র আমেরিকার জন্য ছিল আতংক আর সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য ছিল ক্ষমতার ভারসাম্য। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের জন্য এই অস্ত্রটি ছিল হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, আর এই একই বিষয় চীনের জন্য ছিল এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। অন্যদিকে, ইজরায়েল, ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়ার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র হলো ক্ষমতাধরদের সাথে টিকে থাকার এক মহামূল্যবান জাদুর কাঠি। 

এই পারমাণবিক মরণাস্ত্রটি এখন পর্যন্ত নয়টি দেশের নিয়ন্ত্রণে। যদিও ইরান পারমাণবিক ক্ষমতাধর হওয়ার প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে বলে আশংকা করছে পশ্চিমা বিশ্ব৷ সেই আশংকা থেকে একের পর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এসেছে দেশটির উপর৷ কিন্তু বর্তমানে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইসরায়েলের দ্বন্দ্ব এখন আর কথা কাটাকাটির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার পাল্টাপাল্টি হামলা বেড়েই চলেছে বিগত কয়েকদিন ধরে। পারমাণবিক অপসারণ চুক্তি বা NPT-এর মতো আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পারমানবিক শক্তিধর দেশের সদস্য সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যদিও ভারত, পাকিস্তান ও ইজরায়েল কখনোই এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। 

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ

একদিকে এই অস্ত্রগুলো হয়তো বড় শক্তিগুলোর মধ্যে সরাসরি যুদ্ধকে ঠেকিয়ে রেখেছে, কিন্তু অন্যদিকে এই একই প্রযুক্তি পৃথিবীকে প্রতিনিয়ত আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোর জন্য, যারা পারমাণবিক শক্তিধর দেশের প্রতিবেশী, তাদের জন্য এই বাস্তবতা অত্যন্ত কঠিন। এই অসুস্থ পারমাণবিক শক্তির প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে আসার কি কোনো পথ আছে নাকি ধ্বংসই হবে দেশগুলোর একমাত্র পরিণতি? 

তথ্যসূত্র-

Related posts

কেন ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনের? ইতিহাসে মজার কাহিনী

শেখ আহাদ আহসান

পৃথিবীর প্রথম ভিডিও গেমের গল্প

কামুক, শিশু ভক্ষণকারী ডাইনি ‘লিলিথ’

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More