Image default
রহস্য রোমাঞ্চ

নেফারতারির কবরের অজানা গল্প- কী আছে তার ভেতরে?

মিশর এক রহস্যময় নগরী, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে আজও আপন রহস্যকে আগলে রেখেছে নিঃশব্দে।

এমনি এক রহস্যে ঘেরা নেফারতারির সমাধি। নেফারতারি ছিলেন রামেসেস দ্বিতীয়ের সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী, আর তার বিলাসবহুল সমাধিই এর প্রমাণ। এই সমাধিতে থাকা পুনঃসংস্কার করা চিত্রগুলোতে উঠে এসেছে এক চমকপ্রদ গল্প। মৃত্যুর জগৎ থেকে সূর্যদেবতা রা এর আলোয় পৌঁছানোর পথে নেফারতারির যাত্রা।

নেফারতারি কে ছিলেন?

নেফারতারি ছিলেন প্রাচীন মিশরের অন্যতম বিখ্যাত রানী। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় রামেসেস এর সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী। তিনি বেঁচে ছিলেন প্রায় ৩৩০০ বছর আগে, ১৯তম রাজবংশের সময়। রানী হিসেবে তিনি নানা উপাধি পেয়েছিলেন “মহান রাজরানী”, “ঈশ্বরের স্ত্রী”, “ফেরাওয়ের মা”, “উত্তর ও দক্ষিণ মিশরের রানী”। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি উপাধি ছিল “যার জন্য সূর্য উদয় হয়”। এটি বোঝায়, রামেসেস তাঁকে কতটা ভালোবাসতেন।

নেফারতারির সমাধি কোথায় অবস্থিত

নেফারতারির প্রতি এই ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে দ্বিতীয় রামেসেস তাঁর জন্য একটি অসাধারণ সমাধি নির্মাণ করেন, যেটি অবস্থিত ছিল “ভ্যালি অব দ্য কুইনস” বা “তাসেত নেফেরু”-তে। সমাধিটি খাড়া পাহাড় কেটে বানানো হয়েছিল এবং এর ভেতর রয়েছে ধাপে ধাপে নামা করিডোর ও কক্ষ।

রানী নেফারতারির সমাধি

নেফারতারির সমাধির দেয়ালের চিত্রকলা

যদিও প্রাচীন কালে ডাকাতরা সমাধিটি লুট করে নিয়ে গিয়েছিল, তবুও কিছু ছোটখাটো সামগ্রী, যেমন কাপড়, গয়না, জুতা ও মূর্তির টুকরো এখনও রয়ে গেছে। কিন্তু আসল সম্পদ হলো এই সমাধির দেয়ালজুড়ে আঁকা চমৎকার চিত্রকর্ম।

সেই সময়ের শিল্পীরা দেয়ালগুলোতে প্রথমে লাল রঙ দিয়ে ছবি এঁকেছিলেন, তারপর কালো রঙ করেছিলেন। এরপর কারিগররা প্লাস্টারে খোদাই করে অবয়ব তৈরি করেন, তারপর রঙ দিয়ে চিত্রগুলোকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেন। প্রায় ৫,২০০ বর্গফুট এলাকায় আঁকা এই চিত্রগুলো এখনো রঙিন ও স্পষ্ট।

চিত্রগুলোর বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে, দুইটি আলাদা দল এগুলো এঁকেছিল—একটি দলের আঁকা তুলনামূলক ভাবে বেশি নিখুঁত। এর মধ্যে এমন কিছু চিত্র রয়েছে যা মৃত্যুর পর জীবনের এক এক ধাপের প্রতিচ্ছবি।

নেফারতারির সমাধির দেয়ালের চিত্রকলা

রানী নেফারতারির মৃত্যুর পর যাত্রা

প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস অনুযায়ী, সমাধি ছিল একেকটি ভিন্ন জগৎ। এর ছাদ আকাশের প্রতীক, মেঝে পৃথিবী, আর গভীরতম কক্ষ, যেখানে মৃতদেহ রাখা হতো, তা ছিল মৃত্যুর দেবতা ওসিরিসের রাজত্ব।

‘বুক অব দ্য ডেড’-এ উল্লেখ করা হয়েছে , ওসিরিস বিচার করতেন মৃত ব্যক্তির আত্মা সৎ ছিল কি না। যদি আত্মা সৎ হতো, তবে সূর্য দেবতা রে এর সঙ্গে পুনর্জন্মের যাত্রা শুরু হতো। এই যাত্রায় আত্মাকে নানা জ্ঞান দেখাতে হতো। নেফারতারির সমাধির দেয়ালে এইসব ধাপ চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।

সমাধির বিশেষ অংশ

সমাধির প্রধান কক্ষে চারটি স্তম্ভ রয়েছে, যেগুলোতে ওসিরিসের ছবি আঁকা আছে। ওসিরিস কখনো মানুষের মতো, আবার কখনো প্রতীকী চিহ্ন হিসেবে ফুটে উঠেছে। এখানেই রাখা হয় নেফারতারির গোলাপি গ্রানাইটের কফিন, যা এখনো আংশিকভাবে রয়ে গেছে।

এই কক্ষে আরও আঁকা আছে দেবতা আনুবিস (যিনি মৃতদেহের রক্ষক), দেবী আইসিস ও আরও অনেকে, যারা রানীকে মৃত্যুর পরবর্তী যাত্রায় সহায়তা করেন।

উর্ধ্বজগতে যাত্রা

সমাধির এক ডাবল সিঁড়ির মাধ্যমে নেফারতারির আত্মা নিচে নামে ও উপরে উঠে যায়। সিঁড়ির দেয়ালে আঁকা আছে রানীর আধ্যাত্মিক যাত্রার ধাপগুলো। 

নিচে রয়েছে দেবী নেফথিস, যিনি সোনার প্রতীকীতে উপবিষ্ট, যা দেবতাদের অমরত্বের প্রতীক। তার ওপরে আনুবিস পাহারা দিচ্ছেন। পাশে রানীর নাম লেখা কার্টুশ, যার ওপর এক বিশাল সাপ ডানা মেলে পাহারা দিচ্ছে।

এই যাত্রার এক পর্যায়ে রানী দেবী আইসিস, নেফথিস ও সত্যের দেবী মাত-এর কাছে পূজা নিবেদন করছেন।

পুনর্জন্মের দ্বারপথ

এইসব পর্যায় পার করে নেফারতারি পৌঁছান এক বিশেষ কক্ষে। সেখানে রাতের যাত্রা শেষ হয়ে দিনের যাত্রা শুরু হয়। এখানেই আঁকা রয়েছে দেবী নেখবেট (উপরের মিশরের রক্ষক) যিনি তাঁর ডানা ছড়িয়ে রানীকে রক্ষা করছেন।

রানী এরপর দেবতা খেপরির সামনে হাজির হন, যিনি পোকা রূপে সূর্যের প্রতীক। পাশেই রয়েছে দেবী হাথোর ও রে-হোরাখতি—ভোরের সূর্যদেবতা।

রানীর আত্মার চূড়ান্ত রূপান্তর

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আসে সমাধির একটি কক্ষে, যেখানে ওসিরিস ও সূর্যদেবতা আত্মার মিলন ঘটে। একটি বিশেষ চিত্রে সবুজ রঙের মমি-রূপী একটি ভেড়া দেখা যায়। এর মাথায় সূর্য থাকে, এবং গায়ের রঙ ওসিরিসের প্রতীক। এটি বোঝায়—“ওসিরিস রে-তে বিশ্রাম নিচ্ছেন” এবং “রা ওসিরিসে বিশ্রাম নিচ্ছেন।” অর্থাৎ, রানীর আত্মা দুই দেবতার মাঝামাঝি অবস্থানে নতুন রূপ লাভ করেছে।

আত্মার মুক্তি ও অমরত্ব

শেষ পর্যন্ত রানী পৌঁছান এমন এক কক্ষে যেখানে তাঁর আত্মা সূর্যের আলোয় বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি নেয়। ‘বুক অব দ্য ডেড’-এর একটি মন্ত্র এখানে লেখা আছে—“আলোতে বেরিয়ে আসার ও ফিরে যাওয়ার প্রার্থনা।” দেয়ালের চিত্রে দেখা যায়, রানী সেনেট নামে এক খেলা খেলছেন (যা পুনর্জন্মের প্রতীক)। আবার এক জায়গায় তিনি বা রূপে চিত্রিত, যেখানে একটি পাখির শরীর এবং তাঁর মানুষের মাথা। এই আত্মার অংশটি দিনে বাইরে উড়ে বেড়াতে পারে এবং রাতে সমাধিতে ফিরে আসে।

আরও একটি দৃশ্যে দেখা যায়, রানীর দেহ শুয়ে আছে, মাথায় নেফথিস ও পায়ে আইসিস দাঁড়িয়ে আছেন দুজনেই ঘুঘুর মতো রূপে। রানী পূজা করছেন বেনু নামের এক পাখিকে, যা সূর্য ও পুনর্জন্মের প্রতীক।

নেফারতারির সমাধি কেবল এক রাজরানির বিশ্রামের স্থান নয়, এটি আমাদের দেখায় প্রাচীন মিশরীয় বিশ্বাস, শিল্প, ধর্ম এবং মৃত্যুর পর জীবনের এক অপূর্ব কাহিনি। দেয়ালে আঁকা প্রতিটি ছবি, প্রতিটি দেবতার প্রতীকী উপস্থিতি, প্রতিটি রঙ ও প্রতিটি প্রতীক আজও মানুষকে বিস্মিত করে। এটি শুধু ইতিহাস নয়- এক জীবনের গল্প, যেখানে মৃত্যু শেষ নয়, বরং নতুন সূচনার দরজা।

তথ্যসূত্র

Related posts

আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের পূর্বসূরী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাশাস্ত্র

যেভাবে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লো পারমাণবিক অস্ত্র

বদ নজর কী- সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানে বদনজর থেকে মুক্তির উপায়!

আশা রহমান

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More