Image default
সভ্যতা

গুপ্ত যুগ: ভারতের ‘গেম অব থ্রোনস’!

গুপ্ত যুগ মানেই কেবল সোনালী দিন আর শান্তির ইতিহাস? একদম ভুল! এর ভেতরেও ছিল ‘গেম অব থ্রোনস’-এর মতো সিংহাসনের জন্য লড়াই, রক্তের খেলা আর চরম বিশ্বাসঘাতকতা!

‘গেম অব থ্রোনস’! নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে তলোয়ারের ঝনঝনানি, সিংহাসনের জন্য ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র, রক্তের স্রোত আর ক্ষমতার লড়াই। জর্জ আর. আর. মার্টিনের এই কাল্পনিক জগৎ যদি বাস্তব ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া যায়, কেমন হবে? 

অবিশ্বাস্য মনে হলেও, প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন একটি অধ্যায় ছিল, যা অনেক ক্ষেত্রেই ‘গেম অব থ্রোনস’-এর নাটকীয়তাকেও হার মানায়। বলছি গুপ্ত সাম্রাজ্যের কথা (প্রায় ৩২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ)। এই যুগকে একদিকে যেমন ‘ভারতের স্বর্ণযুগ’ বলা হয় তার অভূতপূর্ব সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য, ঠিক তেমনই এর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে সিংহাসন দখলের রক্তাক্ত লড়াই, ভ্রাতৃহত্যা, রাজনৈতিক চক্রান্ত আর দিগ্বিজয়ী সম্রাটদের পাশবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। 

গুপ্ত সাম্রাজ্যকে কেন ‘গেম অব থ্রোনস’ বলা চলে, সেই রহস্য উন্মোচন এবং সেই স্বর্ণযুগের রাজনৈতিক যুদ্ধ, উত্থান-পতন ও গৌরবগাথাই আমাদের এই দীর্ঘ আলোচনার বিষয়।

পটভূমি: গুপ্তদের উত্থান

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে উত্তর ভারতে কোনো একক, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। ছোট ছোট রাজ্য, বিদেশি শক্তির (যেমন কুষাণ, শক) আনাগোনা সব মিলিয়ে একটা রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। এই প্রেক্ষাপটেই চতুর্থ শতাব্দীর শুরুতে গঙ্গার উর্বর উপত্যকায় উদয় হয় গুপ্ত বংশের। 

সম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্ত

বংশের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীগুপ্ত হলেও, ঘটোৎকচের পুত্র প্রথম চন্দ্রগুপ্তকেই (শাসনকাল আনুমানিক ৩২০-৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ) এই সাম্রাজ্যের প্রকৃত ভিত্তি স্থাপনকারী হিসেবে ধরা হয়। লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমারদেবীর সাথে তার বিবাহ শুধুমাত্র একটি পারিবারিক বন্ধন ছিল না, এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যা গুপ্তদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এই বিবাহের স্মৃতি বহন করে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারদেবীর প্রতিকৃতিসহ স্বর্ণমুদ্রা প্রচলিত হয়েছিল। তার ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণই জানান দেয় যে, তিনি এক নতুন এবং উচ্চাভিলাষী সাম্রাজ্যের সূচনা করছেন। 

এখান থেকেই ভারতের সেই প্রাচীন স্বর্ণযুগের পথচলা শুরু, যা পরবর্তী দুই শতাব্দী ধরে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও সামরিক শক্তিতে উপমহাদেশকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। তবে এই উত্থানের পথ মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বরং ক্ষমতার প্রতিটি ধাপে ছিল অদৃশ্য কাঁটার আঘাত।

সমুদ্রগুপ্ত: ভারতের নেপোলিয়ন

প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পর গুপ্ত সিংহাসনে বসেন তার সুযোগ্য পুত্র সমুদ্রগুপ্ত (শাসনকাল আনুমানিক ৩৩৫-৩৮০ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি গুপ্ত বংশের শ্রেষ্ঠ শাসকই ছিলেন না, সাথে প্রাচীন ভারতের অন্যতম সেরা সামরিক প্রতিভাও ছিলেন তিনি। তার অসীম সাহস, দূরদর্শিতা এবং রণকৌশলের কারণে ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ তাঁকে ‘ভারতের নেপোলিয়ন’ আখ্যা দিয়েছেন।

এদিকে, সমুদ্রগুপ্তের হৃদয়ে ছিল ‘চক্রবর্তী’ সম্রাট (সমগ্র ভারতবর্ষের একচ্ছত্র অধিপতি) হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, যা তাকে একের পর এক রক্তক্ষয়ী সামরিক অভিযানে চালিত করে। তার এই বিজয়গাথার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় তার সভাকবি হরিষেণ রচিত এলাহাবাদ স্তম্ভলিপিতে (প্রয়াগ প্রশস্তি)। এলাহাবাদ স্তম্ভলিপি অনুসারে, সমুদ্রগুপ্ত আর্যাবর্তের (উত্তর ভারত) নয়জন রাজাকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করে তাদের রাজ্য সরাসরি সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। দক্ষিণাপথের (দক্ষিণ ভারত) বারোজন রাজার বিরুদ্ধে তিনি ‘গ্রহণ-মোক্ষ-অনুগ্রহ’ নীতি গ্রহণ করেন – অর্থাৎ, তিনি তাদের পরাজিত করে রাজ্য কেড়ে নিলেও পরে তাদের বশ্যতা স্বীকার সাপেক্ষে রাজ্য ফিরিয়ে দেন এবং কর আদায় করেন। 

যুদ্ধরত সমুদ্রগুপ্ত

এছাড়াও, তিনি অটবিক (বনবাসী) রাজ্যসমূহ, সীমান্তবর্তী রাজ্যসমূহ (যেমন সমতট, ডবাক, কামরূপ, নেপাল, কর্তৃপুর) এবং মালব, যৌধেয়, অর্জুনায়ন, মদ্র, আভীর প্রভৃতি গণরাজ্যকে নিজের আধিপত্য মানতে বাধ্য করেন। এমনকি সুদূর সিংহল (শ্রীলঙ্কা) এবং অন্যান্য দ্বীপের শাসকেরাও তার কাছে উপঢৌকন পাঠাতেন।

সমুদ্রগুপ্তের এই সামরিক অভিযানগুলি নিছক রাজ্যজয় ছিল না, এর মাধ্যমে তিনি এক বিশাল ও সুসংহত সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। তবে এই বিশাল সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা এবং তা আরও প্রসারিত করার নেশা পরবর্তী গুপ্ত শাসকদের মধ্যেও সংক্রামক রোগের মত ছড়িয়ে  গিয়েছিল, যা জন্ম দেয় আরও অনেক রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সংঘাতের। ‘গেম অব থ্রোনস’-এর মতো, এখানেও বিভিন্ন ‘রাজা’ ও ‘প্রভু’ তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য নিরন্তর সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, যার কেন্দ্রে ছিলেন সমুদ্রগুপ্তের মতো শক্তিশালী শাসকেরা।

গুপ্তসাম্রাজ্যের ম্যাপ

‘গেম অব থ্রোনস’ মোমেন্ট: দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের উত্থান

সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে কে সিংহাসনে বসবেন, তা নিয়ে যে নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা ‘গেম অব থ্রোনস’-এর যেকোনো শ্বাসরুদ্ধকর পর্বের চেয়ে কম নয়। যদিও এলাহাবাদ প্রশস্তিতে সমুদ্রগুপ্ত তার পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেছিলেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কিছু ঐতিহাসিক সূত্র এবং বিশাখদত্তের নাটক ‘দেবীচন্দ্রগুপ্তম’ (বর্তমানে লুপ্ত, তবে এর অংশবিশেষ অন্যান্য গ্রন্থে টিকে আছে) এক ভিন্ন ও রোমাঞ্চকর ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে।

মুদ্রায় অশ্বারোহী দ্বিতীয় চন্দ্র গুপ্ত

এই আখ্যান অনুসারে, সমুদ্রগুপ্তের পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র রামগুপ্ত সিংহাসনে বসেন। রামগুপ্ত ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির এবং অযোগ্য শাসক। এই সুযোগে বিদেশি শক জাতি গুপ্ত রাজ্য আক্রমণ করে এবং রামগুপ্তকে এক অপমানজনক সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। সন্ধির শর্তানুসারে, রামগুপ্ত তাঁর স্ত্রী ধ্রুবাদেবীকে (বা ধ্রুবস্বামিনী) শকরাজের হাতে তুলে দিতে রাজি হন। এই চরম অসম্মানের মুহূর্তে রুখে দাঁড়ান রামগুপ্তের ছোট ভাই, সাহসী ও বিচক্ষণ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত।

তিনি ছদ্মবেশে ধ্রুবাদেবীর পালকিতে করে শক শিবিরে প্রবেশ করেন এবং সুযোগ বুঝে শকরাজকে হত্যা করেন। এই বীরোচিত কাজের পর রাজ্যে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। পরবর্তীতে, তিনি দুর্বল ও কাপুরুষ রামগুপ্তকে হত্যা করে (অথবা সরিয়ে দিয়ে) সিংহাসন দখল করেন এবং ধ্রুবাদেবীকে বিবাহ করেন। 

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য: স্বর্ণযুগের পূর্ণ বিকাশ ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (শাসনকাল আনুমানিক ৩৮০-৪১৫ খ্রিস্টাব্দ), যিনি ‘বিক্রমাদিত্য’ (বীরত্বের সূর্য) উপাধি ধারণ করেছিলেন, তিনি কেবল একজন সাহসী যোদ্ধা ও কূটনীতিবিদই ছিলেন না, তিনি ছিলেন শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির এক মহান পৃষ্ঠপোষক। তার শাসনকালেই গুপ্ত সাম্রাজ্য তার সমৃদ্ধি ও গৌরবের শীর্ষে আরোহণ করে। গুপ্ত যুগকে যে ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয়, তার পূর্ণাঙ্গ রূপটি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়েই গড়ে ওঠে।

সামরিক সাফল্য

পিতার মতোই দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী ছিলেন। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কৃতিত্ব হলো পশ্চিম ভারতের শক-ক্ষত্রপদের উচ্ছেদ করা। এর ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্য পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয় এবং লাভজনক সামুদ্রিক বাণিজ্যের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

নবরত্ন সভা

নবরত্ন সভা 

কিংবদন্তি অনুসারে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজসভা ‘নবরত্ন’ অর্থাৎ নয়জন জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি দ্বারা অলংকৃত ছিল। এদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন মহাকবি কালিদাস, যার ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’, ‘মেঘদূতম্’, ‘রঘুবংশম্’, ‘কুমারসম্ভবম্’ প্রভৃতি রচনা আজও বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। যদিও নবরত্নের ধারণাটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে এবং সকল রত্ন তার সমসাময়িক ছিলেন কিনা তা নিশ্চিত নয়, তবে এটি তার রাজসভার সাংস্কৃতিক উৎকর্ষকেই নির্দেশ করে।

বিজ্ঞান ও গণিতের অগ্রগতি 

এই যুগে আর্যভট্ট (যদিও তার সময়কাল চন্দ্রগুপ্তের কিছুটা পরে, তবে গুপ্ত যুগেই তার আবির্ভাব) শূন্যের (০) ধারণা দেন, পাই (π) এর মান নির্ণয় করেন এবং সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের প্রাথমিক ধারণা দেন। বরাহমিহির জ্যোতির্বিদ্যা ও ফলিত জ্যোতিষে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ধাতুবিদ্যায়ও ভারত অভাবনীয় উন্নতি লাভ করে, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো দিল্লির কুতুব মিনার প্রাঙ্গণে অবস্থিত মরিচাবিহীন লৌহস্তম্ভটি, যা প্রায় ১৬০০ বছর পরেও অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।

আর্যভট্ট

স্থাপত্য ও ভস্কর্য 

গুপ্ত যুগে আর্যরীতি ও দ্রাবিড়রীতি মন্দির স্থাপত্যের বিকাশ শুরু হয়। দেওগড়ের দশাবতার মন্দির, ভিতরগাঁওয়ের ইটের মন্দির, সাঁচি ও উদয়গিরির গুহামন্দিরগুলো এই সময়ের স্থাপত্যশৈলীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বুদ্ধমূর্তি এবং মথুরা শিল্পরীতির ভাস্কর্যগুলো গুপ্তকালীন শিল্পকলার নন্দনতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিকতার গভীরতার পরিচয় দেয়। অজন্তা ও ইলোরার কিছু গুহাচিত্রও এই সময়ের শিল্পরুচির সাক্ষ্য বহন করে।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি

কৃষি, শিল্প ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারের ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্য অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। রোম, চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার সাথে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। গুপ্ত রাজারা প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণমুদ্রা (দিনার) ও রৌপ্যমুদ্রা প্রচলন করেন, যা তাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ।

একদিকে যেমন সিংহাসনের জন্য ছিল স্নায়ুক্ষয়ী লড়াই, অন্যদিকে তেমনই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পের এমন অভাবনীয় বিকাশ – এই বৈপরীত্যই গুপ্ত যুগকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।

পতনের প্রেক্ষাপট

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের পর তার পুত্র প্রথম কুমারগুপ্ত (শাসনকাল আনুমানিক ৪১৫-৪৫৫ খ্রিস্টাব্দ) এবং পৌত্র স্কন্দগুপ্ত (শাসনকাল আনুমানিক ৪৫৫-৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ) সাম্রাজ্যের গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখতে সফল হয়েছিলেন। প্রথম কুমারগুপ্তের সময়ে নালন্দা মহাবিহার একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। আর, স্কন্দগুপ্তকে দুর্ধর্ষ হুন আক্রমণ প্রতিহত করে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে হয়েছিল। তার বীরত্বের কথা ভিতরী স্তম্ভলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পরই গুপ্ত সাম্রাজ্যের সেই অজেয় রূপ ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করে। এর পেছনে একাধিক কারণ ছিল:

দুর্বল উত্তরাধিকারী 

স্কন্দগুপ্তের পর পরবর্তী শাসকেরা ছিলেন তুলনামূলকভাবে দুর্বল এবং অযোগ্য। তারা বিশাল সাম্রাজ্যের উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হন।

অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও সামন্তদের উত্থান 

কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হওয়ার সুযোগে বিভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তা ও সামন্ত রাজারা ক্রমশ স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। মালব, সৌরাষ্ট্র, কনৌজ প্রভৃতি অঞ্চলে স্থানীয় শাসকেরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেন। 

হুন জাতির আক্রমণ

পুনরায় হুন আক্রমণ 

ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে তোরামান এবং তার পুত্র মিহিরকুলের নেতৃত্বে হুনরা আরও শক্তিশালী হয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারত আক্রমণ করে। এই বর্বর আক্রমণে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সামরিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও গুপ্তরা সরাসরি হুনদের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হননি, কিন্তু এই ক্রমাগত সংঘাত তাদের শক্তি ক্ষয় করে দেয়।

অর্থনৈতিক সংকট 

ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহ, বিশেষ করে হুনদের সাথে লড়াই গুপ্ত সাম্রাজ্যের অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। পাশাপাশি, বাণিজ্য পথগুলোও আগের মতো সুরক্ষিত ছিল না। ফলে দেখা দেয় অর্থনৈতিক সংকট। 

এই সম্মিলিত কারণগুলো গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পথ প্রশস্ত করে। একসময় যে সাম্রাজ্য জ্ঞান-বিজ্ঞান আর বীরত্বে সমগ্র উপমহাদেশকে আলোকিত করেছিল, তা ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করে।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন: এক স্বর্ণযুগের অবসান

ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্য কার্যত খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার সুযোগে স্থানীয় শাসকেরা ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি হুন আক্রমণের ধাক্কা এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দল গুপ্তদের কোমর ভেঙে দেয়। যদিও গুপ্ত বংশের কিছু শাখা আরও কিছুদিন মগধ ও তার আশেপাশে রাজত্ব করেছিল, কিন্তু তাদের সেই পূর্বের প্রতাপ আর ছিল না। ৫৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের মূল ধারাটি ইতিহাসের পাতা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

‘গেম অব থ্রোনস’-এর টারগারিয়ানদের মত শক্তিশালী সাম্রাজ্যের যেভাবে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারনে পতন হয়েছিল, গুপ্তদের পতনও ছিল তেমনই নাটকীয়। বাহ্যিক শত্রু (হুন) এবং অভ্যন্তরীণ বিভেদ (দুর্বল শাসক, সামন্তদের বিদ্রোহ) একদা অজেয় এই সাম্রাজ্য ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। আর স্বর্ণযুগের আলো নিভে গিয়ে ভারতে আবার নেমে আসে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার এক ‘দীর্ঘ রাত্রি’, যা পরবর্তীকালে হর্ষবর্ধনের উত্থানের আগে পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।

পরিশেষে বলা যায়, গুপ্ত যুগকে ‘ভারতের গেম অব থ্রোনস’ বলাটা হয়তো একটু বাড়াবাড়ি শোনাতে পারে, কিন্তু এর ভেতরের আসল সত্যিটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সিংহাসন নিয়ে রক্তারক্তি, রাজনৈতিক প্যাঁচঘোঁচ, বিরাট সব যুদ্ধ আর বাঘা বাঘা সব নেতাদের উত্থান-পতন এই সবকিছুই গুপ্ত আমলের গল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ। 

তবে হ্যা, এর পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য আর সংস্কৃতি যেভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছিল, তা এককথায় অসাধারণ! এই দুটো দিক মিলেই গুপ্ত যুগ ভারতীয় ইতিহাসে এমন এক দাগ কেটেছে, যা আজও আমাদের অবাক করে আর নতুন করে ভাবায়। গুপ্তদের কাহিনি শুধু রাজায়-রাজায় মারামারি বা কে জিতল কে হারল, সেই গল্প নয়; এটা একটা গোটা সভ্যতার একেবারে চূড়ায় ওঠা আর তারপর ধীরে ধীরে পতনের এক জীবন্ত ছবি, যা ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে চিরদিন লেখা থাকবে।

তথ্যসূত্র –

Related posts

সাত সতীর ছায়ায় মহেঞ্জোদারো: এক রহস্যময় অধ্যায়ের উন্মোচন

ইন্দুস ভ্যালির ভাষা রহস্য: হারিয়ে যাওয়া এক সভ্যতার নিঃশব্দ কণ্ঠস্বর

নক্ষত্রেই ছিল নাবাতিয়ানদের ঈশ্বর? পেত্রার পাথরে লেখা মহাকাশের ধর্মকথা

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More