Image default
ইতিহাস ১০১

খিচুড়ির ইতিহাস: উপমহাদেশের এই প্রাচীন খাবারের অজানা গল্প

খিচুড়ি নিয়ে যতই বাঙালি আবেগ থাকুক, এ খাবারের উৎস বাংলা নয়।

‘খিচুড়ি’ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের একটি সুপরিচিত খাবার। বাঙালির কাছে আবার খিচুড়ির সঙ্গে মিশে আছে ভিন্ন এক রোমান্টিসিজম। মেঘলা দিনে, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি নামার সঙ্গে সঙ্গে খিচুড়ির আবেদন আরও বেড়ে যায় আমাদের কাছে। এসময় ধোঁয়া ওঠা এক প্লেট গরম খিচুড়ি যেন চোখ ও মনের শান্তি!

প্রথম খিচুড়ি রান্না শুরু হয় ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে। যদিও বাংলায় কবে থেকে এই খাবার তৈরি হয়েছে তা নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব। ভারতবর্ষে বেড়াতে আসা বিভিন্ন পরিব্রাজকদের লেখা এবং কিছু দেশীয় গ্রন্থের সূত্র অনুযায়ী খিচুড়ির ঐতিহাসিক উপস্থিতির সাক্ষ্য গ্রহণ করে চলেছে।

খিচুড়ির নামকরণ

সংস্কৃত ভাষায় ‘খেচরান্না’ বলে একটি শব্দ আছে, যার বাংলা করা হয়েছে খিচুড়ি। ‘বিশ্বকোষ’ জানাচ্ছে, খিচুড়ি শব্দটি খেচর শব্দজাত। আরও জানা যাচ্ছে, চাল ও কলা দিয়ে রান্না করা খাবারই হলো খিচুড়ি। 

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ বইয়ে জানাচ্ছেন, প্রাকৃত শব্দ ‘কিসর/কৃসরা’ শব্দ থেকে ক্রমান্বয়ে খিচরি (রী/ড়ি/ড়ী) হয়ে খিচুড়ি শব্দের বিবর্তন হয়েছে। মিশ্রিত চাল, ডাল, ঘি ইত্যাদি দিয়ে রান্না করা খাবারই খিচুড়ি।

সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন অঞ্চলে এর উচ্চারণ ও বানানে পরিবর্তন এসেছে; যেমন বাংলায় “খিচুড়ি”, হিন্দিতে “খিচড়ি”, উর্দুতে “খিচরি” ইত্যাদি।

খিচুড়ির ইতিহাস

আমাদের বাঙ্গালিদের মধ্যে প্রাচীনকালে ডাল খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না। আমরা যদি প্রাচীন বাংলা সাহিত্য দেখি, সেখানে কিন্তু ডাল এর কথা উল্লেখ নেই। ডাল মূলত এসছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে, আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে। ডাল আসার পরেই খিচুড়ি খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের দিকে দেখতে গেলে আজ থেকে প্রায় দু হাজার বছর আগে আমরা খিচুড়ি রান্নার নিদর্শন পাচ্ছি। ২০১৫ সালে ভারতের মহারাষ্ট্রে যখন খনন কার্য করা হচ্ছিল তখন দুটো বড় পাত্র পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে চাল অর্থাৎ ভাত এবং মুগ ডাল পোড়ার চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। ধারণা করা হয় এই পাত্র দু’টিতে দুই হাজার বছর আগে মানুষ খিচুড়িই রান্না করছিল।

বিভিন্ন রকমের খিচুরি

ইতিহাস ঘাটলে আরও জানা যায়, মেগাস্থিনিস থেকে আকবর, জাহাঙ্গীর থেকে জগন্নাথ; সবাই-ই খিচুড়ির স্বাদ আস্বাদন করেছেন। পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে যে চাল–ডালে রান্না করা খিচুড়ি ভীষণ জনপ্রিয়, তার প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় সেলুকাসের লেখায়। সেলুকাস লেখেন, চালের সঙ্গে ডাল মেশানো খাবার খুবই জনপ্রিয় ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে।

সেলুকাসের মতো মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা উল্লেখ করেছেন কিশরি–র কথা। এই কিশরি বা কিসরি রান্না হতো চাল ও মুগ ডাল দিয়ে। রুশ পর্যটক আফনাসিই নিকতিন ১৫ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে ঘুরতে এসে খিচুড়ির কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর লেখায়। 

মৌর্য যুগে চন্দ্রগুপ্তর শাসনামলে চাল–ডালের মিশ্রণে তৈরি খিচুড়ির কথা বলেছেন চাণক্য। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রান্নাঘরে খিচুড়ি রান্না হতো বলে লিখেছেন গ্রিক পরিব্রাজক মেগাস্থিনিস। আরও পরে সপ্তদশ শতকে ফরাসি পরিব্রাজক তাভেরনিয়ের লিখেছেন, সে সময় ভারতের প্রায় সব বাড়িতেই খিচুড়ি খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। এও জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির হাত ধরে ইংল্যান্ডেও নাকি পৌঁছে যায় খিচুড়ি। 

মুঘলদের সময় খিচুড়ি কতটা জনপ্রিয় ছিল

বাবর বা হুমায়ুনের কালে খিচুড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়নি এটা ঠিক, তবে আকবরের সময় থেকে মুঘল হেঁশেলে খিচুড়ির উল্লেখ মিলতে থাকে। আকবরের মন্ত্রী ছিলেন আবুল ফজল; সুলেখক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি তাঁর লেখা ‘আইন-ই-আকবরি’তে সাত রকমের খিচুড়ির রেসিপি লিখেছিলেন। জানা গেছে, তখন রাজকীয় মুঘল রান্নাঘরে নাকি বিভিন্ন ধরণের খিচুড়ি তৈরি হত।

এমনকি, সেই বইয়ে ‘বীরবলের খিচুড়ি’ নামে একটি মজার গল্পের উল্লেখও পাওয়া যায়। সেখানে আকবর এবং বীরবলের খিচুড়ি রান্নার কথা বলে হয়েছে। খিচুড়ির প্রতি ভালো লাগা ছিল সম্রাট জাহাঙ্গিরেরও। জাহাঙ্গিরের প্রিয় খিচুরিতে থাকত পেস্তা ও কিশমিশ। সেই খিচুড়িকে জাহাঙ্গির ভালবেসে নাম রেখেছিলেন ‘লাজিজাঁ’। মুঘল রান্নাঘরে আরেক ধরণের খিচুরিতে চাল ও ডালের সঙ্গে মেশানো হত বিভিন্ন প্রকার মাছ ও ডিম। এই খিচুড়ির নাম ‘আলমগিরি খিচড়ি’। এই খিচুড়ি ছিল সম্রাট আড়ঙ্গজেবের প্রিয়।

পেস্তা ও কিশমিশ দেওয়া খিচুড়ি

হুমায়ুন যখন শেরশাহের তাড়া খেয়ে পারস্য পৌঁছালেন, সেখানকার শাহকে তিনি নিমন্ত্রণ করে ভারতীয় খিচুড়ি খাইয়েছিলেন। আর তা খেয়েই নাকি শাহ ঠিক করলেন, হুমায়ুনকে পারস্যে আশ্রয় দিবেন।

মুঘল বাদশাদের খিচুড়ি প্রীতি বংশানুক্রমে চলছিল। জাহাঙ্গির একবার ভুট্টার খিচুড়ি খেয়ে মোহিত হয়ে মুঘল হেঁশেলে জায়গা দেয় খিচুড়ি।

ঢাকায় খিচুড়ি

এই one-pot meal খিচুড়ি সাধারণত যাত্রাপথের খাবার হিসেবে জন্ম নিয়েছে। তীর্থযাত্রীদের জন্য সবচেয়ে কম ঝামেলার খাবার যেমন খিচুড়ি, তেমনি যুদ্ধ-অভিযানে আগুয়ান সেনাবাহিনীর জন্যও খিচুড়ি পরিবেশিত হয়েছে। 

মনসামঙ্গল কাব্যে পার্বতীর কাছে স্বয়ং শিব ডাবের জল দিয়ে রান্না করা মুগের ডালের খিচুড়ি খেতে চেয়েছিলেন। কৈলাসে তো নারকেলগাছ নেই যে ডাব পাওয়া যাবে! মনসামঙ্গলের লেখক বিজয় গুপ্ত ছিলেন বরিশালের মানুষ। যেখানে নারকেল ও ডাব সহজলভ্য। ফলে বিজয় গুপ্তের কল্পনায় শিব যে ডাবের জল দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি খেতে চাইবেন, সে আর আশ্চর্য কী!

প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী তাঁর বিখ্যাত রান্নার বই আমিষ ও নিরামিষ আহারে জানিয়েছেন যে, ‘সৈন্যের গুণে যেমন সেনাপতির খ্যাতি বর্ধিত হয়, সেই রূপ আনুষঙ্গিক খাদ্যের গুণে প্রধান খাদ্য সমধিক রুচিকর হইয়া ওঠে। খিচুড়ির এই আনুষঙ্গিক খাদ্যের মধ্যে তখনো প্রধান হলো ইলিশ। আরো নির্দিষ্ট করে বললে ইলিশ ভাজা। গলা খিচুড়ি আর ভুনা খিচুড়ি উভয়ই বাঙালির অন্যতম প্রিয়।’ খিচুড়ির সঙ্গে পরিবেশিত আনুষঙ্গিক খাদ্যগুলো ঢাকার নিজস্ব ঐতিহ্যের স্বাক্ষর।

সেই ঐতিহ্যের ধারা টিকিয়ে রেখে খিচুড়ি পরিবেশনের জন্য ঢাকার সাধারণ মানুষ থেকে নামজাদা রেস্তোরাঁ সকলেই প্রস্তুত। আলু ভর্তা, কালিজিরা ভর্তা, সরিষা ভর্তা ও বেগুন ভর্তা থাকবে প্লেটের চারপাশে সাজানো। সঙ্গে অর্ধেক ডিম ভাজি। খিচুড়ির জন্য আলাদা পরিচিতি পাওয়া দোকানের অস্তিত্বও লুকিয়ে আছে এই ঢাকা শহরে। 

খিচুরি ও ইলিশ ভাঁজা

বর্ষার সাথে খিচুড়ির সম্পর্ক

বর্ষা, বাঙালি এবং খিচুড়ি- এই ত্রয়ীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বৃষ্টির দিনগুলোতে বাঙালি খিচুড়ি খেতে খুবই পছন্দ করেন। কিন্তু কেন? আসলে গ্রাম বাংলায় বর্ষাকাল ছিল বিড়ম্বনার সময়। পপ্রবল বর্ষায় বাজারঘাট, রান্নাবান্না অসুবিধাজনক হয়ে পড়ত। গৃহস্তবাড়ীতে তখন রান্নাঘর থাকত একটু বাইরের দিকে। সেখানে রান্না করতে গিয়ে ভিজতে হত।এ সময় বাড়ির গৃহিণীরা চাল ও ডাল মিলিয়ে খুব দ্রুত এবং ঝামেলা মুক্ত ভাবে রেঁধে ফেলত খিচুড়ি।ঘরে আলু বা সবজি থাকলে তা খিচুরিতে মিশিয়ে দিত।এসব কারনেই বৃষ্টির দিনের সঙ্গে খিচুড়ির সংস্কৃতি মিলে মিশে একাকার। বর্ষায় তাজা ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। তাই খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজাও জড়িয়ে গেছে। এন্য একটি ব্যাপারও লক্ষণীয়। খিচুড়ি এমনিতে গুরপাক খাবার। এতে অনেকের হজমের সমস্যা হয়। বৃষ্টির সময়ে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় খিচুড়ি খেয়ে এই অসুবিধা অনেকখানি কাটিয়ে উথা যায়।

তথ্যসূত্রঃ

Related posts

প্রতারণার ইতিহাস – যখন মিথ্যা হয়ে ওঠে সত্য!

আবু সালেহ পিয়ার

জনপ্রিয় ফাস্ট ফুড- বার্গার এর ইতিহাস

যৌন শিক্ষার পূর্বে যৌনতা কেমন ছিল?

আবু সালেহ পিয়ার

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More