ঘুমের প্রকৃত শত্রু আসলে প্রযুক্তি নিজেই।
রাত গভীর। শহরের আলো ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। জানালার ওপারে নীরব অন্ধকার। আমরা বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, যেন সেটাই চিরন্তন নিয়ম। রাতজেগে কাজ করাকে অস্বাভাবিক মনে হয়, আর মাঝরাতে জেগে ওঠাকে ঘুমের ব্যাধি ধরে নিই।
কিন্তু আপনি কি জানেন, শত শত বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এমনটাই করতেন? তারা রাতভর একটানা ঘুমাতেন না। তারা ঘুমাতেন দুই ভাগে। ঘুম, তারপর এক দীর্ঘ বিরতি, তারপর আবার ঘুম। এই প্রথা আজকের সমাজে হারিয়ে গেছে। কিন্তু থেকে গেছে ইতিহাসের পাতায়।
চলুন, ফিরে যাই সেই সময়ে, যেখানে ঘুম ছিল একটি সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক, এবং সামাজিক পর্ব।
আদিম মানুষ ও ঘুমের অস্তিত্বগত প্রয়োজন
ঘুমকে আমরা আজ যে রকম দেখি, তা আসলে ইতিহাসের একদম সাম্প্রতিক রূপ। প্রাচীন কালে প্রাকৃতিক পরিবেশে টিকে থাকার সংগ্রামে ঘুম ছিল বিপজ্জনক কাজ। একটানা ঘুমানো তাদের জন্য অসম্ভব ছিল। সেসময় রাতে শিকারিরা সক্রিয় থাকত। তাই আদিম মানুষরা খণ্ডকালীন ঘুমের মাধ্যমে বেঁচে থাকার কৌশল রপ্ত করে। কারণ পাহারা, আগুন জ্বালিয়ে রাখা, শত্রু থেকে রক্ষা ইত্যাদি ছিল রাতের কাজ। তখন ঘুম আলাদা আলাদা সময়ে ছড়িয়ে থাকা একাধিক সংক্ষিপ্ত পর্বে বিভক্ত ছিল। দিনের মধ্যে ছোট ছোট বিরতিতে ঘুমানোই ছিল তাদের বাস্তবতা।
যখন মানুষ ধীরে ধীরে সংগঠিত সমাজ গঠন করতে শুরু করে, তখন ঘুম হয়ে উঠল আধ্যাত্মিকতার অংশ। এই সময় ঘুমকে ব্যাখ্যা করা হত ধর্ম, দর্শন, আর মিথের আলোকে। প্রাচীন গ্রিকদের দৃষ্টিতে ঘুম ছিল দেবতার নিয়ন্ত্রণে। তারা বিশ্বাস করত, হিপনোস নামের দেবতা মানুষের ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ করেন। হিপনোসের ভাই থানাটোস ছিলেন মৃত্যুর দেবতা। তারা বিশ্বাস করত ঘুম ও মৃত্যু একে অপরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। ঘুম যেন মৃত্যুর একটি নরম, সাময়িক সংস্করণ।
ভারতের প্রাচীন উপনিষদীয় দর্শনে ঘুমকে দেখা হয়েছে আত্মার এক গভীর স্তর হিসেবে। তাদের মতে, ঘুমের মধ্যে মানুষ তার জাগ্রত চেতনাকে হারিয়ে ফেলে এবং তখন সে ‘পরম সত্যের’ সংস্পর্শে আসে। এই ভাবনার সঙ্গে জড়িত ছিল আত্মা, পুনর্জন্ম ও মোক্ষের ধারণা। এছাড়াও প্রাচীন মিশরীয়দের কাছেও ঘুম ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তারা ঘুম ও স্বপ্নকে দেবতাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে দেখত। তাদের বিশ্বাস ছিল, স্বপ্নের মধ্য দিয়ে দেবতারা মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, ভবিষ্যতের বার্তা দেন, কিংবা অতীতের রহস্য উদ্ঘাটন করেন। তারা ঘুমকে স্বর্গের পবিত্র দ্বার হিসেবে দেখত। মনে করত ঘুমের মাধ্যমে মানুষ স্বর্গের আলো ছুঁতে পারে।
মধ্যযুগে ঘুম: বিভক্ত ঘুমের এক সামাজিক রীতি
হাজার বছর ধরে মানুষের ঘুমের ধরণ ছিল অনেকটাই আলাদা। এমনকি অবাক করার মতো। মধ্যযুগে এবং তারও আগে ইউরোপ, ভারতবর্ষ জুড়ে এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের সমাজেও রাতের ঘুম ছিল দুই ভাগে বিভক্ত। সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছু সময় পরে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ত। এই প্রথম ধাপের ঘুম চলত প্রায় চার ঘণ্টা। তারপর রাত ১২টা থেকে ১টার দিকে মানুষ জেগে উঠত। কখনও এক ঘণ্টা, কখনও দেড় ঘণ্টা, কখনওবা তারও বেশি সময়ের জন্য। এই জেগে থাকার সময় ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, সামাজিকভাবে স্বীকৃত এবং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারপর আবার শুরু হতো দ্বিতীয় ধাপের ঘুম। এই ঘুম চলত ভোর অবধি।
এই দুই দফা ঘুমের সময়সীমা ছিল প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রাকৃতিক আলো-অন্ধকারের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল মানুষের দেহঘড়ি। আধুনিক গবেষণা বলছে, মানুষের শরীরে যে সার্কাডিয়ান রিদম বা দৈনিক জৈব ঘড়ি রয়েছে যা এমনভাবে গড়ে উঠেছে বা বিবর্তিত হয়েছে যেন আমরা প্রাকৃতিকভাবেই দুই ধাপে ঘুমাতে পারি। এই কারণে অনেক সময় আমরা গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠি, এবং মনে হয় ঘুম ভেঙে গেছে। কিন্তু আসলে এটি আমাদের দেহের প্রাকৃতিক আচরণ।
মধ্যরাতের ‘জাগরণকাল’: ঘুমের বিরতিতে চলত জীবনের নিঃশব্দ অধ্যায়
ঘুমের দুই ভাগের মাঝখানের জেগে থাকা সময়কে বলা হতো “watch” বা “quiet wakefulness”। এই সময়টিকে একধরনের উপযোগী, অর্থবহ সময় হিসেবে দেখা হতো। আধুনিক সময়ের চোখে এই মাঝরাতের জেগে থাকা হয়তো ঘুমভঙ্গ বা ইনসমনিয়ার মতো মনে হতে পারে। কিন্তু ইতিহাস বলছে একেবারেই ভিন্ন কথা।
ঐতিহাসিক দলিলপত্র ও সাহিত্যে এই ধরনের ঘুমের কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সময়ে মানুষ প্রার্থনা করত, অনেকেই বাইবেল পড়ত, নামাজ আদায় করত, ধ্যান বা জিকিরে মগ্ন থাকত। কারণ এই সময়টিকে তারা ধর্মীয়ভাবে পবিত্র ও নির্জন বলে মনে করত। কেউ কেউ আত্মবিশ্লেষণ করত এই সময়। অনেকেই এই সময়ে নিজের দুঃখ, আনন্দ, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, পাপবোধ বা জীবনের গভীর প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবত। আবার অনেক দম্পতি এই সময় যৌনতায় যুক্ত হতো। কারণ শারীরিক ও মানসিকভাবে তারা তখন চাপমুক্ত থাকত। কেউ কেউ নীরব এই রাতে বসে যেত কাপড় সেলাই করতে, কাঠের কাজ বা চিঠি লিখতে। কেউবা বই পড়ত। এই জাগরণকাল ছিল আত্মিক প্রশান্তি ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য বরাদ্দ সময়। এই “watch” সময় প্রাক-আধুনিক ঘুমচক্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল।
সাহিত্য ও ইতিহাসে ঘুমের এই দুই ধাপের প্রমাণ
সাহিত্য ও ইতিহাসে ঘুমের দুই ধাপের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৫শ শতকের ইংলিশ কবি জেফরি চসারের রচনায় “first sleep” এবং “second sleep” শব্দ দুটির উল্লেখ রয়েছে। ১৬শ ও ১৭শ শতকের চিকিৎসাবিদ্যার বইগুলোতেও এই শব্দগুলো পাওয়া গেছে। যেখানে “প্রথম ঘুমের পর” মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা কেমন থাকে, তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এমনকি ১৮শ শতকের ফরাসি আদালতের দলিলেও “after the first sleep” শব্দগুচ্ছ দেখা যায়। এই শব্দ রাতের মাঝখানের সময়কে বোঝাতে ব্যবহার হতো।
মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার বহু গ্রামীণ সমাজেও দুই ধাপে ঘুমানোর অভ্যাসের প্রমাণ মেলে। অনেক ভারতীয় লোককাহিনিতে মাঝরাতে দুধ গরম করা, মন্দিরে প্রার্থনা করা, বা গ্রামীণ নারীদের নিঃশব্দে কাজ করার দৃশ্য পাওয়া যায়। ইউরোপেও এই সময় রান্নাঘরের তন্দুরে রুটি বানানো হতো, কেউবা প্রতিবেশীর বাড়িতে গল্প করতে যেত। ঘুমের মাঝখানের এই সময়টি ছিল সামাজিক, ধর্মীয় এবং ব্যক্তিগত অভ্যস্ততার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
শিল্পবিপ্লবের পর আলো আসলো, আর ঘুম হারিয়ে ফেললো তার প্রাকৃতিক রূপ
১৮শ শতকের শেষে এবং ১৯শ শতকে ইউরোপে শুরু হলো শিল্পবিপ্লব। শহরে বাড়তে লাগল কৃত্রিম আলোর ব্যবহার। গ্যাস ল্যাম্প আর পরে বৈদ্যুতিক বাতি রাতকে বদলে দিল। এখন রাতও কাজের সময়। দোকান খোলা থাকে, পত্রিকা ছাপে, ফ্যাক্টরি চলে, ট্রেন চলে। এই নতুন জীবন ঘুমের উপর চেপে বসল।
মানুষকে সকালে খুব ভোরে কাজে যেতে হতো। ফলে তারা রাতভর জেগে থেকে দ্বিতীয়বার ঘুমানোর সময় পেত না। ধীরে ধীরে সমাজ একটানা ঘুমকে ‘নিয়মিত’ এবং দুই ধাপে ঘুমকে ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে দেখতে শুরু করে।
বিশ্বজুড়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানও একই পথে হাঁটল। “ইনসমনিয়া” বা ঘুমের ব্যাঘাতের সংজ্ঞা তৈরি হলো। মাঝরাতে জেগে উঠাকে সমস্যা হিসেবে ধরা হলো। অথচ প্রাক-আধুনিক সমাজে সেটাই ছিল নিয়ম।
বিজ্ঞান কী বলে? দুই ধাপে ঘুম কি শরীরের জন্য ভালো ছিল?
২০১২ সালে ইতিহাসবিদ রজার একিরচ (Roger Ekirch) দুই ধাপে ঘুমের অস্তিত্বের পক্ষে, তার বিখ্যাত বই At Day’s Close: Night in Times Past -এ বহু প্রমাণ হাজির করেন। এরপর বিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে নিয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু করেন।
স্লিপ সায়েন্টিস্ট থমাস ওয়েথার (Thomas Wehr) এক গবেষণায় ১৪ জন মানুষকে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক আলোর পরিবেশে রেখে দেখেছিলেন।তিনি দেখেন কৃত্রিম আলো ছাড়া থাকার ফলে তাদের ঘুম দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তারা স্বাভাবিকভাবে প্রথমে চার ঘণ্টা ঘুমায় তারপর জেগে থাকে এক ঘণ্টা দিয়ে আবার ঘুমায়।
এটি প্রমাণ করে, মানুষের শরীর প্রকৃতিগতভাবেই দুই ধাপে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত ছিল। কৃত্রিম আলো ও আধুনিক সময়চক্র সেটিকে বদলে দিয়েছে।
আজকের দিনে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আমরা ভয় পাই কেন?
আজকাল অনেকেই মাঝরাতে হঠাৎ জেগে ওঠেন। ঘুম আর আসে না। বিছানায় গড়াগড়ি করেন, মোবাইল হাতে নেন। নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। ‘ঘুমাতে পারছি না’, এই বোধ থেকেই মানসিক চাপ বাড়ে, ফলে ঘুম আরও দূরে সরে যায়।
কিন্তু ইতিহাস বলছে, এই জেগে উঠা অস্বাভাবিক না। বরং এটি আপনার শরীরের প্রাকৃতিক ছন্দের একটি চিহ্ন। হয়তো আপনার শরীর এখনো সেই পুরনো, বিভক্ত ঘুমের ছন্দেই অভ্যস্ত।
স্লিপ সায়েন্টিস্টরা বলেন, এই সময়টা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে বরং বই পড়া, মৃদু ধ্যান, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম বা হালকা কাজ করা যেতে পারে। এতে দ্বিতীয় ধাপের ঘুম সহজেই ফিরে আসে।
ভবিষ্যতের ঘুম কি আবার অতীতের পথ ধরবে?
আজকের ব্যস্ত শহরজীবনে হয়তো দুই ভাগে ঘুমানো সম্ভব নয়। আমাদের কাজের সময়, আলোর ব্যবহার, সামাজিক চাপ সবকিছুই একটানা ঘুমের পক্ষে কাজ করছে। তবে কেউ কেউ আজও পলিফ্যাসিক স্লিপ পদ্ধতি অনুসরণ করেন। অর্থাৎ দিনে একাধিকবার ছোট ছোট ঘুম।
কিছু মানুষ রাত ৯টায় ঘুমিয়ে ১টায় উঠে কিছু কাজ সেরে আবার ঘুমান ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত। কেউ আবার দিনের বেলায় ২০ মিনিটের পাওয়ার ন্যাপ নেন একাধিকবার। হয়তো আগামী দিনে আমরা নতুন ঘুমচক্র দেখতে পারব। হয়তো এটা আমাদের দেহঘড়ি ও কাজের ছন্দ উভয়ের সঙ্গে মানানসই হবে।
ঘুম আমাদের মনের প্রতিচ্ছবি। একটি সময় ছিল, যখন রাতের ঘুম দুই ভাগে বিভক্ত থাকলেও মানুষ বিভক্ত ছিল না। তারা সময়কে আপন করে নিয়েছিল, রাতের অন্ধকারকে ভয় না পেয়ে বরং ভালোবেসেছিল। সেই নির্জন মধ্যরাত ছিল ধ্যানের সময়, প্রেমের সময়, আত্মার সঙ্গে সংলাপের সময়।
আজ আমরা আলোর মাঝে বাস করি। অথচ ঘুম আমাদের বারবার ডাকে সেই পুরনো ছন্দে ফিরতে। মাঝরাতে যদি জেগে যান, বুঝবেন আপনার শরীর আপনাকে কিছু বলতে চাচ্ছে। হয়তো বলবে, “এই সময়টা তোমার; তুমি ভাবো, লেখো, অনুভব করো। তারপর আবার ঘুমাও।” ঘুম যেন জীবনের আর্তস্বর।