মুসলিমদের সঙ্গে ইসরাইলের অঘোষিত যুদ্ধের যেন কোন শেষ নেই! এমন কর্মকাণ্ডের আভাস এবং পরিণতি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আগেই সতর্ক করেছিলেন মহান আল্লাহ্ তায়ালা স্বয়ং। তবে কি কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী আসলেই সত্যি হচ্ছে?
ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাত শুধু একটি ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু নয়, বরং এটি ইসলামী বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি ঐশী পরিকল্পনার অংশ। এমনকি কুরআন ও হাদিসে ইসরাইল (বনি ইসরাইল) ও ফিলিস্তিন ভূমির ভাগ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। বর্তমানে ইসরাইলের অত্যাচার ও ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা দেখে অনেকেই কুরআনের সেই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো স্মরণ করছেন। বর্তমানে অনেকের মনেই প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে যে, তবে কি সত্য হচ্ছে কুরআনের বাণী, ই’সরায়েলের পতন কি সন্নিকটে?
কুরআনে বনি ইসরাইলের ধ্বংসের ভবিষ্যৎবাণী ও বাস্তব চিত্র
১. “অষ্টম দশকের অভিশাপ”: তালমুদের এক অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বাণী
“অষ্টম দশকের অভিশাপ” (আরবিতে “লা’নাতুল আকদিস সামিন”) শব্দটি ইহুদি ধর্মীয় গ্রন্থ তালমুদ থেকে উদ্ভূত একটি ভবিষ্যদ্বাণী থেকে এসেছে। এই ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে, কোনো ইহুদি রাষ্ট্র আট দশকের বেশি টিকবে না এবং এটি ভেঙে যাবে, তবে ভাঙনের কারণ বাইরের কোনো শক্তি নয়, বরং নিজেদের মধ্যকার জাতি-উপজাতির কোন্দল। ইতিহাসও এই ভবিষ্যদ্বাণীকে সমর্থন করেছে, কারণ কিং ডেভিড এবং হাসমোনিয়ান রাজত্ব ছাড়া আজ পর্যন্ত কোনো ইহুদি রাজ্য ৮০ বছরের বেশি টেকেনি। বর্তমানে ইসরাইল রাষ্ট্রটি ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং ২০২৮ সালে এটি ৮০ বছর পূর্ণ করবে। যদি তালমুদের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়, তাহলে তিন-চার বছরের মধ্যে ইসরাইল রাষ্ট্রটির পতন ঘটতে পারে।
২. সূরা বনি ইসরাইলে দুটি বড় ফাসাদ ও পতনের ঘোষণা
ইতিহাসের পাতায় বারবার বিতাড়িত, অপমানিত এবং ধ্বংস হয়েছে ‘বনী ইসরাইল’। তাদের অতীতের পাপ, নবীদের হত্যা, ফিতনা ও ফাসাদের জন্য আল্লাহ তাআলা তাদের উপর কঠিন শাস্তি প্রেরণ করেছেন। এই শাস্তির বর্ণনা কেবল ইতিহাসেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং পবিত্র কোরআনেও স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। সূরা বনি ইসরাইলের আয়াতসমূহে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে, বনী ইসরাইল পৃথিবীতে দুইবার বিশাল ফাসাদ সৃষ্টি করবে। প্রতিবারই আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে পাঠাবেন তাঁর কঠোর ও শক্তিশালী বান্দাদের, যারা তাদের চরম পরাজয়ের স্বাদ দেবে।
ইতিহাসবিদরা বিশ্বাস করেন, প্রথম বিপর্যয়টি ইতোমধ্যে ঘটে গেছে। তাদের মতে এটি ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ অব্দে। যখন নব্য অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের রাজারা বনী ইসরাইলকে আক্রমণ করে জেরুজালেম দখল করেন। এটিই ছিল হযরত দাঊদ (আঃ) ও সুলাইমান (আঃ)-এর প্রতিষ্ঠিত ইহুদি সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা।
কিন্তু আধুনিক ইসলামি গবেষক ও মুফাসসিরদের মতে, দ্বিতীয় বিপর্যয় এখনও ঘটেনি। কুরআনের ইঙ্গিত অনুযায়ী, দ্বিতীয় বিপর্যয়টি ইমাম মাহদী (আঃ)-এর আগমন এবং মুসলিমদের নেতৃত্বে জেরুসালেম বিজয়ের সময় সংঘটিত হবে। বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুসলিম নিপীড়ন, এবং ইসরাইলের আগ্রাসন একত্রিত হয়ে অনেকের মনে একটি প্রশ্ন তৈরি করেছে – ‘আমরা কি এখন সেই দ্বিতীয় ওয়াদার প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে আছি?’
আবার, কোরআনের সূরা বনি ইসরাইলের আয়াত ৪-৮ এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে,
“তোমরা পৃথিবীতে দু’বার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে… অতঃপর আমি কঠোর বান্দাদেরকে তোমাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করলাম… তারা মসজিদে ঢুকে পড়ল… মুখমণ্ডল বিকৃত করল… যদি আবার করো, আমিও তাই করব…”
আজকের দিনে, যেখানে বনী ইসরাইল বা ইসরায়েল রাষ্ট্র রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে, কোরআনের এই বার্তা মনে করিয়ে দেয় যে, যদি তারা আবারও সীমালঙ্ঘন করে, তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে পুনরায় আঘাত আসবে। এটি হতে পারে সেই দ্বিতীয় ওয়াদার বাস্তবায়ন, যা এখনো অপেক্ষমাণ।
৩. ইহুদিদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়
আল্লাহ তাআলা সূরা বনি ইসরাইলের ৬ নম্বর আয়াতে বলেন:
“অতঃপর আমি তোমাদেরকে তাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী করলাম, তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতিতে সমৃদ্ধ করলাম এবং সংখ্যায় অধিক করে দিলাম।”
(সূরা বনি ইসরাইল, ১৭:৬)
বহু মুফাসসিরের মতে এই আয়াতটি এমন এক ভবিষ্যৎবাণীর দিকে নির্দেশ করে যে, ইসরাইল আপাতদৃষ্টিতে বিজয়ী হলেও, চূড়ান্ত বিজয় মুসলমানদেরই হবে। বর্তমানে ইসরাইল সামরিক প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক প্রভাবে অনেক শক্তিশালী, কিন্তু এই শক্তির পেছনে রয়েছে দম্ভ, জুলুম এবং আল্লাহর বিধান অমান্য করার প্রবণতা।
কুরআনের ভাষা থেকে বোঝা যায়, মুসলমানরা একসময় তাদের ওপর বিজয়ী হবে, আল্লাহর সাহায্যে ধন-সম্পদ ও জনশক্তিতে শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং দমন-পীড়নের এই চক্রের অবসান ঘটাবে। বর্তমান বাস্তবতায় যদিও ইসরাইল প্রভাবশালী, তবে আল্লাহর দেওয়া এই প্রতিশ্রুতি আমাদেরকে আশ্বস্ত করে যে, তাদের পতন একদিন হবেই। আর সেই বিজয় হবে ঈমানদারদের পক্ষেই।
৪. ইহুদিদের শেষ পরিণতি: পাথর ও গাছের মাধ্যমে ধ্বংস
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ভবিষ্যদ্বাণীমূলক হাদিসে ইহুদিদের শেষ পরিণতি সম্পর্কে বলেন:
“কিয়ামত আসবে না, যতক্ষণ না মুসলমানরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের হত্যা করবে। এমনকি ইহুদিরা যদি পাথর ও গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে, তবুও পাথর বা গাছ বলে উঠবে: ‘হে মুসলিম! হে আল্লাহর বান্দা! আমার পেছনে একজন ইহুদি লুকিয়ে আছে, এসো তাকে হত্যা কর।’ কেবল গারকাদ গাছ এ কথা বলবে না, কেননা তা ইহুদিদের গাছ।” – (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯২২)
এই হাদিসটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, শেষ যুগে এক মহাযুদ্ধে মুসলমানরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করবে। এমনকি প্রকৃতিও মুসলিমদের পক্ষ নিয়ে সাহায্য করবে। পাথর ও গাছ পর্যন্ত কথা বলবে, যাতে ইহুদি লুকিয়ে থাকতে না পারে। তবে গারকাদ নামক একটি বিশেষ গাছ ইহুদিদের পক্ষ নেবে, যেটিকে আজ ইসরাইলি সেনা ক্যাম্প ও স্থাপনাগুলোর চারপাশে ব্যাপকভাবে রোপণ করতে দেখা যায়।
বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, গাজা, পশ্চিম তীর এবং মুসলিম জনগণের প্রতিরোধ, সেইসাথে আন্তর্জাতিকভাবে ইসরাইল বিরোধী মনোভাব ক্রমেই বাড়ছে। অনেক আলেম ও চিন্তাবিদ মনে করেন, এই প্রতিরোধ ও জাগরণই হয়তো সেই ভবিষ্যৎবাণীপূর্ণ যুদ্ধের প্রাথমিক ধাপ।
কুরআন-হাদিসের আলোকে ইসরাইলের ভবিষ্যৎ
কুরআন ও হাদিসের ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী, ইসরাইল একটি অস্থায়ী রাষ্ট্র, যার পতন অবশ্যম্ভাবী। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বনি ইসরাইলের ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন,
যে তারা একসময় পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের পতন হবে। যেমনটি সূরা বনি ইসরাইলের আয়াতে বলা হয়েছে, ইহুদিরা দু’বার ফাসাদ সৃষ্টি করবে, যার পরিণতি হবে তাদের ধ্বংস। – (সূরা বনি ইসরাইল, ১৭:৪-৫)
ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, মুসলিমরা একদিন জেরুসালেম ও ফিলিস্তিন মুক্ত করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
“মুসলিমরা একদিন জেরুজালেম দখল করবে।”
এটি এমন একটি ভবিষ্যৎবাণী, যা প্রতিটি মুসলিমের অন্তরে আশা ও আশাবাদ জাগিয়ে তোলে। কিছু হাদিসে বলা হয়েছে, এই মুক্তি হবে ইমাম মাহদির আগমনকালে বা তার পরবর্তীতে, যখন মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইহুদি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবে এবং ফিলিস্তিনকে মুক্ত করবে।
ইসরায়েল এখন যতই শক্তি ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বে দাপট দেখাক না কেন, কুরআনের আয়াত ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস আমাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, এই দুনিয়ায় তাদের দম্ভ বেশি দিন টিকবে না। তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী, এবং সেই পথ আল্লাহ তাআলা আগে থেকেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমরা বর্তমানে এমন এক যুগে প্রবেশ করেছি, যখন কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ধীরে ধীরে বাস্তব হয়ে উঠছে। এই অবস্থা আমাদের বার বার মনে করিয়ে দেয়, বিজয় অবশ্যই ঈমানদারদেরই হবে।
তথ্যসূত্র
- https://www.kalerkantho.com/online/Islamic-lifestylie/2024/11/06/1443384
- https://www.amadershomoy.com/islam/article/124570/%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%B0%E0%A6%86%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%80-%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A6%BE-%E0%A6%86%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%80-%E0%A6%87%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A6%BE
- https://www.somoynews.tv/news/2023-10-11/X6SuE5PK
- https://youtu.be/_SbCDGhC0dk?si=vCBOJAFNOo1eP6EA
চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলিমদের অবদান- সার্জারি থেকে মৃতদেহ সংরক্ষণ