“একটি গন্ধ কখনো কখনো মানুষের একেকটি স্মৃতিকে ধারণ করে”
ছোটো বেলায় নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিয়েছেন কখনো? ছাপাখানার কি সুন্দর গন্ধ মিশে থাকতো সেই নতুন বইয়ে। বইটা হাতে পেয়েই যেনো প্রথম কাজ ছিলো বইয়ের গন্ধ শোঁকা। আপনার কী মনে হয় সবারই এই গন্ধ ভালো লাগে? নাহ, সবারই এই গন্ধ ভালো লাগে না। কারো কারো কাছে এই গন্ধ বিরক্তিকরও লাগে। একই তো বই তাহলে এমন কেনো হয়? ভেবেছেন কখনো?
চলুন, সেই রহস্য ভেদ করা যাক।
নাক দিয়ে গন্ধ কীভাবে পৌঁছায়
ঘ্রাণতন্ত্র বা অলফ্যাক্টরি সিস্টেম হলো আমাদের শরীরের একটি জটিল নিউরোসেন্সরি সিস্টেম। এই নিউরোসেন্সরি সিস্টেম গন্ধ শনাক্ত ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য দায়ী। নাকের ভেতরের উপরের অংশে অলফ্যাক্টরি এপিথেলিয়াম নামে একটি অঞ্চল থাকে, যেখানে লক্ষ লক্ষ ঘ্রাণ রিসেপ্টর কোষ থাকে। এই রিসেপ্টর কোষগুলো বাতাসে ভাসমান গন্ধের অণুগুলো রিসিভ করে। যখন কোনো গন্ধের অণু এই রিসেপ্টরের সাথে বাঁধা পড়ে, তখন একটি রাসায়নিক সংকেত তৈরি হয়। যা নিউরোসেন্সরি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্কে পৌঁছায়।
নাক দিয়ে গন্ধ কীভাবে মস্তিষ্কে পৌঁছায়? প্রথমে, গন্ধের অণুগুলো নাকের মাধ্যমে শ্বাসের সাথে প্রবেশ করে এবং অলফ্যাক্টরি এপিথেলিয়ামে পৌঁছায়। এরপর, অলফ্যাক্টরি নার্ভ (ক্র্যানিয়াল নার্ভ ) এই সংকেতগুলো মস্তিষ্কের অলফ্যাক্টরি বাল্বে পাঠায়। এই বাল্ব থেকে সংকেতগুলো মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে, যেমন লিম্বিক সিস্টেম এবং অলফ্যাক্টরি কর্টেক্সে পৌঁছে, যেখানে গন্ধের প্রক্রিয়াকরণ এবং বোঝাপড়া ঘটে। মূলত এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই মানুষ আলাদা আলাদা গন্ধ অনুভব করতে পারে।
ঘ্রাণ অনুভব করার পেছনের বিজ্ঞান
ঘ্রাণ অনুভবের পেছনে রয়েছে জটিল জৈব রাসায়নিক এবং স্নায়বিক প্রক্রিয়া। মানুষের নাক প্রায় ৪০০ ধরনের ঘ্রাণ রিসেপ্টরের মাধ্যমে হাজার হাজার গন্ধ শনাক্ত করতে পারে। প্রতিটি গন্ধের অণু একটি নির্দিষ্ট রিসেপ্টরের সাথে মিলে যায়, যা একটি অনন্য স্নায়বিক সংকেত তৈরি করে। এই সংকেতগুলো মস্তিষ্কের অলফ্যাক্টরি কর্টেক্সে পৌঁছে গন্ধ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
এই প্রক্রিয়ার একটি আকর্ষণীয় দিক হলো, ঘ্রাণতন্ত্র সরাসরি মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত, যা আবেগ এবং স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ কারণে, একটি নির্দিষ্ট গন্ধ আমাদের মনে তীব্র আবার কোনোটা ঘ্রাণ মৃদু।
মানুষের ঘ্রাণ শক্তি মস্তিষ্কের সম্পর্ক
সবাই এক গন্ধে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেয় কেনো, ঘ্রাণের স্মৃতি ও আবেগের সম্পর্ক নিউরোসেন্সরি সিস্টেম কিভাবে ঘ্রাণ গ্রহণ করে? মূলত ঘ্রাণের সঙ্গে মস্তিষ্কের সংযোগ বিভিন্ন মানুষের রুচির কারণ ও খাবারের সম্পর্ক নাক দিয়ে গন্ধ মস্তিষ্কে পৌঁছায় এবং স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পুরনো বইয়ের গন্ধ কাউকে তাদের শৈশবের লাইব্রেরির কথা মনে করিয়ে দিতে পারে।
মানুষের ঘ্রাণের প্রতি সংবেদনশীলতা
মানুষের ঘ্রাণের প্রতি সংবেদনশীলতা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। এর পেছনে জিনগত, পরিবেশগত এবং সাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে। জিনগতভাবে, আমাদের ঘ্রাণ রিসেপ্টরের সংখ্যা এবং তাদের সংবেদনশীলতা ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু মানুষ নির্দিষ্ট গন্ধ, যেমন পেট্রোল বা ঘামের গন্ধ এগুলোর প্রতি অতি সংবেদনশীল হতে পারে কিন্তু অন্যরা সেটা নাও হতে পারে।
পরিবেশও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যারা শহরে বাস করে, তারা দূষণের গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে যায়, যেখানে গ্রামের মানুষ প্রকৃতির গন্ধে বেশি সংবেদনশীল হতে পারে। সাংস্কৃতিক পটভূমিও ঘ্রাণের পছন্দকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, এশিয়ার কিছু দেশে দুরিয়ান ফলের গন্ধকে সুস্বাদু মনে করা হয়, যেখানে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে তা প্রায়শই অপ্রীতিকর বলে বিবেচিত হয়।
কেন সবাই এক গন্ধে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেয়
একই গন্ধের প্রতি ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার পেছনে রয়েছে জিনগত বৈচিত্র্য, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতি। জিনগতভাবে, আমাদের ঘ্রাণ রিসেপ্টরের প্রকারভেদ এবং তাদের সংবেদনশীলতা গন্ধের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু মানুষের জিনে মিউটেশনের কারণে তারা নির্দিষ্ট গন্ধ শনাক্ত করতে পারে না, যাকে বলা হয় অ্যানোসমিয়া।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতিও গন্ধের প্রতি প্রতিক্রিয়াকে গঠন করে। একটি গন্ধ যদি কোনো ইতিবাচক স্মৃতির সাথে যুক্ত থাকে, যেমন দাদির রান্নার গন্ধ, তবে তা মনোরম মনে হবে। বিপরীতভাবে, যদি কোনো গন্ধ নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত থাকে, যেমন হাসপাতালের গন্ধ, তবে তা বিরক্তিকর মনে হতে পারে।
এছাড়া, সাংস্কৃতিক পটভূমি এবং অভ্যাসও গন্ধের পছন্দকে প্রভাবিত করে। আবার যারা হাসপাতালে কাজ করে যেমন ডাক্তার বা নার্স, তারা কিন্তু হাসপাতালের যে গন্ধ সেটার সাথে অভ্যস্ত। তাই প্রথমে রোগী নিয়ে গেলে হাসপাতালের গন্ধে যে প্রতিক্রিয়া জানায় ডাক্তাররা বা নার্সরা কিন্তু সেরকম প্রতিক্রিয়া জানায় না, বরং তার উল্টো প্রতিক্রিয়া জানায়।
ঘ্রাণের স্মৃতি ও আবেগের সম্পর্ক
মানুষের অনুভূতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে স্পর্শকাতর হচ্ছে ঘ্রাণ। মানুষ একটি গন্ধের ৬৫% মনে রাখতে পারে এক বছর পরও। সেখানে দর্শন ইন্দ্রিয় মনে রাখে মাত্র ৫০%। অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের তুলনায় গন্ধ মানুষের অনুভূতির সঙ্গে বেশি জড়িত। এক গবেষণায় বলা হয়, ঘ্রাণ মানুষের প্রশান্তি, ভাল থাকা, অনুভূতি এবং স্মৃতির সঙ্গে প্রায় ৭৫% জড়িত।
ঘ্রাণের সাথে স্মৃতি ও আবেগের গভীর সম্পর্ক রয়েছে, কারণ ঘ্রাণতন্ত্র সরাসরি মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত। লিম্বিক সিস্টেম, যার মধ্যে অ্যামিগডালা এবং হিপোক্যাম্পাস রয়েছে, আবেগ এবং স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ কারণে, একটি নির্দিষ্ট গন্ধ আমাদের মনে অতীতের ঘটনা বা আবেগকে তীব্রভাবে ফিরিয়ে আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বৃষ্টির গন্ধ কাউকে তাদের শৈশবের বর্ষাকালের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে, যা আনন্দ বা নস্টালজিয়ার অনুভূতি জাগাতে পারে।
এই সংযোগ এতটাই শক্তিশালী যে ঘ্রাণ থেরাপি (অ্যারোমাথেরাপি) মানসিক চাপ কমাতে এবং মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ল্যাভেন্ডারের গন্ধ শান্তির অনুভূতি দেয়, যেখানে সাইট্রাসের গন্ধ উৎসাহ বাড়ায়।
ঘ্রাণের সাথে মস্তিষ্কের সংযোগ অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের তুলনায় অনন্য। দৃষ্টি বা শ্রবণ সংকেতগুলো মস্তিষ্কের থ্যালামাসের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকৃত হয়, কিন্তু ঘ্রাণ সংকেত সরাসরি অলফ্যাক্টরি বাল্ব থেকে লিম্বিক সিস্টেমে যায়। এই সরাসরি সংযোগের কারণে ঘ্রাণ আমাদের আবেগ এবং স্মৃতির উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
মস্তিষ্কের অলফ্যাক্টরি কর্টেক্স গন্ধকে চিহ্নিত করে এবং শ্রেণীবদ্ধ করে, যেখানে লিম্বিক সিস্টেম তাকে আবেগের সাথে যুক্ত করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, একটি গন্ধ আমাদের মনের অবস্থা পরিবর্তন করতে পারে বা অতীতের স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে পারে।
ঘ্রাণ ও খাবারের সম্পর্ক
ঘ্রাণ এবং খাবারের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। খাবারের স্বাদের প্রায় ৮০% নির্ভর করে ঘ্রাণের উপর। যখন আমরা খাবার চিবাই, তখন গন্ধের অণুগুলো নাকের পেছনের অংশে পৌঁছে অলফ্যাক্টরি রিসেপ্টরের সাথে মিশে যায়, যা স্বাদের অনুভূতিকে সমৃদ্ধ করে। এ কারণে, সর্দি হলে নাক বন্ধ থাকলে খাবারের স্বাদ কম অনুভূত হয়।
কিছু খাবারের গন্ধ আমাদের ক্ষুধা জাগায়, কিছু গন্ধ, যেমন পচা খাবারের গন্ধ, আমাদের সতর্ক করে। খাবারের গন্ধ আমাদের খাদ্য নির্বাচন এবং পছন্দকে প্রভাবিত করে, এবং এটি সাংস্কৃতিকভাবেও ভিন্ন হয়।
ঘ্রাণ একটি শক্তিশালী ইন্দ্রিয়, যা আমাদের স্মৃতি, আবেগ এবং পছন্দকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এর পেছনে রয়েছে জটিল জৈব রাসায়নিক এবং স্নায়বিক প্রক্রিয়া, যা জিনগত, পরিবেশগত এবং সাংস্কৃতিক কারণের সমন্বয়ে কাজ করে। একই গন্ধ কেন একজনের কাছে সুন্দর আর অন্যজনের কাছে বিরক্তিকর, তা বোঝার জন্য আমাদের ঘ্রাণতন্ত্র, মস্তিষ্কের সংযোগ এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভূমিকা বুঝতে হবে। ঘ্রাণ শুধু একটি ইন্দ্রিয় নয়, এটি আমাদের জীবনের গল্পের একটি অংশ, যা আমাদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে সংযুক্ত করে।
তথ্যসূত্র
- https://sobbanglay.com/sob/how-do-we-smell/
- https://www.dailyjanakantha.com/different-news/news/246864
- https://www.tbsnews.net/bangla/%E0%A6%AB%E0%A6%BF%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0/%E0%A6%86%E0%A6%AA%E0%A6%A8%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A6%BF-%E2%80%98%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E2%80%99-%E0%A6%AF%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A3%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%9B%E0%A7%81-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%81%E0%A6%B7-%E0%A6%98%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A3-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%A6%E0%A6%A8%E0%A6%B6%E0%A7%80%E0%A6%B2-%E0%A6%B9%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%87-%E0%A6%93%E0%A6%A0%E0%A7%87
- https://news.harvard.edu/gazette/story/2022/11/why-smells-trigger-such-potent-memories/
- https://www.scientificamerican.com/article/why-do-smells-trigger-memories1/
- https://www.nature.com/articles/s41593-020-0640-6