পাহাড়ে বেড়াতে ভালবাসেন, পাহাড়ি খাবার ভালবাসেন কিন্তু পাহাড়ে রান্নার নিয়ম জানেন না, তা কী হয়? পাহাড়ে খাবার সিদ্ধ হতে অনেক বেশি সময় লাগে, সেই চিন্তায় পাহাড়ের বুকে রান্নার করার চিন্তাই বাদ দেয় কেউ কেউ। কিন্তু কেন? এই বিচিত্র সমস্যার সমাধান জানা থাকলে পাহাড়ে রান্নার মত সুন্দর অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে পারবেন।
পাহাড়ের মনোরম পরিবেশ যেমন সবার পছন্দ ঠিক তেমনি পাহাড়ি খাবারের ভক্তের সংখ্যাও কম নয়। পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে গরম গরম পাহাড়ি খাবার, বিশেষ করে মাংসের কোনো পদ রান্না করার অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। কিন্তু কখনও কি এমন হয়েছে যে চুলায় পানি টগবগ করে ফুটছে, অথচ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও মাংস কিছুতেই সিদ্ধ হচ্ছে না? এই সাধারণ অথচ অদ্ভুত সমস্যাটি পাহাড়ি অঞ্চলে রান্না করার ক্ষেত্রে একটি পরিচিত ঘটনা।
কিন্তু এই অদ্ভুত সমস্যার পেছনের কারণটা কী? সমস্যা কি মাংসের নাকি পাহাড়ি অঞ্চলের পানির? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোন রহস্যের গন্ধ?
রান্নার প্রাথমিক সমস্যা
পাহাড়ে খাবার তৈরি করতে, বিশেষ করে মাংস বা ডালের মতো জিনিস সিদ্ধ করতে অনেক বেশি সময় লাগে। পানি দ্রুত ফুটে উঠলেও খাবার যেন কাঁচাই থেকে যাচ্ছে। অনেকেই চুলার জোর কম বা জ্বালানির সমস্যাকে এর জন্য দায়ী ভাবেন, কিন্তু আসল কারণটি লুকিয়ে আছে প্রকৃতির এক মৌলিক নিয়মের মধ্যে।
পানি তখনই ফোটে যখন তার বাষ্পীয় চাপ (vapor pressure) পারিপার্শ্বিক বায়ুমণ্ডলীয় চাপের (atmospheric pressure) সমান হয়। সমতলে সমুদ্রপৃষ্ঠে বায়ুমণ্ডলীয় চাপ বেশি থাকে, তাই পানিকে বেশি তাপ দিয়ে তার বাষ্পীয় চাপকে সেই মানে পৌঁছাতে হয়। সাধারণত, সমতলে পানি ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২১০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রায় ফোটে। অন্যদিকে, ভূপৃষ্ঠ থেকে যত উপরে ওঠা যায়, বায়ুমণ্ডলীয় চাপ তত কমতে থাকে। কারণ, উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে মাথার উপরে থাকা বাতাসের স্তর ক্রমেই পাতলা হয়ে আসে।
কম বায়ুমণ্ডলীয় চাপের কারণে পাহাড়ি অঞ্চলে পানি ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে কম তাপমাত্রাতেই ফুটতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, ৫০০০ ফুট উচ্চতায় পানি প্রায় ৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে এবং ১০,০০০ ফুট উচ্চতায় প্রায় ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ফুটতে পারে। এ কারণে পাহাড়ের উপরে পানি তুলনামূলকভাবে কম গরম করলেই ফুটতে দেখা যায়, যা অনেককে অবাক করে। কিন্তু পানি ফুটলেও মাংস সিদ্ধ হয় না।
কারণ যেকোনো খাবার, বিশেষ করে মাংস সিদ্ধ হওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট ন্যূনতম তাপমাত্রা প্রয়োজন। মাংসের ভেতরের কঠিন প্রোটিন (যেমন কোলাজেন) ভেঙে নরম হতে এবং জীবাণুমুক্ত হতে উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। সমতলে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ফুটন্ত পানি এই কাজটি ভালোভাবে করতে পারে। কিন্তু পাহাড়ে পানি কম তাপমাত্রায় ফুটে যাওয়ায়, সেই ফুটন্ত পানির তাপমাত্রা মাংসের কোষকলা সঠিকভাবে ভাঙতে বা জীবাণুমুক্ত করতে অনেকক্ষেত্রেই যথেষ্ট হয় না।
এদিকে, পাহাড়ে অতি দ্রুত পানি ফোটার কারণে তার তাপশক্তি অপেক্ষাকৃত কম জমা হয়। কম তাপমাত্রার ফুটন্ত পানি পুরো খাবারে ধীরে ধীরে তাপ সরবরাহ করে, যার ফলে রান্নার সামগ্রিক প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়। মাংস শক্ত থেকে যায়, সহজে সিদ্ধ হয় না।
পাহাড়ে রান্নার জাদুকরী সমাধান
পাহাড়ের রান্নাকে সহজ করতে প্রেসার কুকার ব্যবহার হতে পারে একটি কার্যকরী সমাধান৷ প্রেসার কুকার একটি আবদ্ধ পাত্রে বাষ্পকে আটকে রেখে পাত্রের ভেতরের চাপ কৃত্রিমভাবে বৃদ্ধি করে। এই চাপের ফলে পানির স্ফুটনাঙ্ক স্বাভাবিক ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে অনেক উপরে উঠে যায় (প্রায় ১২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত)।
এই উচ্চ তাপমাত্রার বাষ্প ও পানি খাবারের ভেতরে দ্রুত প্রবেশ করে এবং মাংস বা অন্যান্য শক্ত খাবার খুব কম সময়ে সুসিদ্ধ করে তোলে, এমনকি উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলেও। একারণেই পাহাড়ি অঞ্চলে দ্রুত ও সঠিকভাবে রান্নার জন্য প্রেসার কুকার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম।
বিকল্প পদ্ধতি
কিন্তু পাহাড়ে প্রেসার কুকারে রান্না করার বিষয়টি বাস্তবতা থেকে অনেকটাই দূরে। কারণ প্রেসার কুকার ওজনে বেশ ভারী। উঁচু পাহাড়ে এই ভারী বস্তুটি বেয়ে উঠা, তাও আবার দ্রুত রান্নার জন্য, খুবই অবাস্তব একটি ভাবনা। এ কারণে পাহাড়ে রান্নার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো অনেক বেশি সময় ধরে রান্না করা। আরেকটি বিকল্প এবং কার্যকরী উপায় হতে পারে মাংস বা সবজি ছোট ছোট টুকরা করে কাটা। এতে করে মাংস ও সবজি দ্রুত সিদ্ধ হয় কারণ এতে খাবারের ভেতর তাপ সহজে ভেতরে প্রবেশ করে।
পাহাড়ে রান্নার আরেকটি সহজ উপায় হলো রান্নার পাত্রটি ঢাকনা দিয়ে ভালোভাবে এঁটে দেওয়া যেন বাষ্প সহজে বেরিয়ে যেতে না পারে। এতে পাত্রের ভেতরে কিছুটা হলেও চাপ ও তাপমাত্রা বাড়বে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, বেশি পানিতে দীর্ঘক্ষণ ধরে রান্না করাও একটি ভালো উপায় হতে পারে।
পাহাড়ে রান্নায় সময় বেশি লাগার মূল কারণ হলো উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বায়ুমণ্ডলীয় চাপ কমে যাওয়া, যার ফলে পানির স্ফুটনাঙ্ক কমে যায়। এই বৈজ্ঞানিক বিষয়টি জানা থাকলে পাহাড়ে ভ্রমণ বা বসবাসের সময় রান্নার পরিকল্পনা সঠিকভাবে করা যায়। প্রেসার কুকারের মতো আধুনিক সরঞ্জাম এই সমস্যা সমাধানে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে, তবে তার পাশাপাশি কিছু চিরাচরিত কৌশলও অবলম্বন করা যেতে পারে কারণ প্রকৃতির নিয়মকে বুঝে তার সাথে মানিয়ে চলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।