সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, গ্রহীয় মিলন, বিরল উল্কাপাত, এমনকি শনি গ্রহের বলয়ও প্রায় অদৃশ্য হতে যাচ্ছে! শুনলে অবাক লাগলেও, এমন মহাকাশীয় ঘটনার সবই ঘটতে চলেছে ২০২৫ এর বছর জুড়ে!
২০২৫ সাল আসছে এক নতুন মহাকাশীয় রোমাঞ্চের বার্তা নিয়ে। এই নতুন বছর হয়তো এমন সব বিস্ময়কর দৃশ্য চোখের সামনে তুলে ধরবে, যাতে মহাকাশপ্রেমী এবং নক্ষত্র পর্যবেক্ষকরা চমৎকৃত না হয়ে পারবেন না। যারা টেলিস্কোপ বা মহাকাশের দিকে চোখ রেখে রহস্যময় সব ঘটনা আবিষ্কার করতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য ২০২৫ হতে চলেছে নিঃসন্দেহে এক বিশেষ বছর।
মহাকাশপ্রেমীরা প্রস্তুত থাকুন! কী কী রহস্যঘেরা ঘটনা নিয়ে আসছে বছরটি, দেখে নেওয়া যাক।
জানুয়ারি ১৮: শনি ও ভেনাসের সংযোগ
২০২৫ সালের আকাশের প্রথম চমকটি ঘটতে যাচ্ছে ১৮ জানুয়ারি। এদিনে ভেনাস এবং শনি গ্রহ একে অপরের খুব কাছে চলে আসবে। মাত্র অর্ধ ডিগ্রি দূরত্বে এই দুই গ্রহকে এক সাথে দেখা যাবে, যা সত্যিই খুব বিরল। সূর্যাস্তের পর দক্ষিণ-পশ্চিম আকাশে দেখা মিলবে ভেনাসের। দেখা যাবে, ভেনাস তার উজ্জ্বল সাদা আলোতে ঝলমল করছে। শনি গ্রহও তার ঠিক পাশেই সোনালি আলোতে ঝলমল করবে।
টেলিস্কোপের মাধ্যমে শনি গ্রহের বিখ্যাত বলয়ও দেখা যাবে, যা এক অসাধারণ দৃশ্য হতে চলেছে। উল্লেখ্য যে, এটি এমন একটি দৃশ্য যা জীবনভর একবারই দেখার সুযোগ মিলবে।
মার্চ ১৪: পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ এবং ব্লাড মুন
১৪ মার্চ, টকটকে লালবর্ণ ধারণ করবে পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ! এ দিনে হবে একটি পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ, যেখানে পৃথিবী, সূর্য এবং চাঁদ একে অপরের সোজা অবস্থানে থাকবে। সোজা অবস্থানে থেকে পৃথিবী যখন তার ছায়া চাঁদের উপর ফেলে, তখন চাঁদ লাল হয়ে ওঠে যাকে বলা হয় “ব্লাড মুন”।
এই ঘটনাটি সাধারণত ঘটে, যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্যে সূর্যের আলো বেঁকে গিয়ে চাঁদের উপর পড়ে। ফলে চাঁদ লাল বা কমলা রঙ ধারণ করে। এই দৃশ্যটি আকাশপ্রেমীদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
মার্চ ২৯: আংশিক সূর্যগ্রহণ
পৃথিবী থেকে একটি আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখতে হলে অপেক্ষা করতে হবে ২৯ মার্চ ২০২৫ সাল পর্যন্ত। এ বিশেষ দিনটিতে সূর্য প্রায় ৮০ থেকে ৯২ শতাংশ আচ্ছন্ন হবে। সূর্যকে দেখা যাবে উজ্জ্বল সোনালী বর্ণে। এক দৃষ্টিতে, সূর্যটির আকার কিছুটা কাঁটাযুক্ত বা চাঁদের মতো লাগবে। উত্তরের অঞ্চলগুলো যেমন- ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, উত্তর এশিয়া, এবং উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা থেকে এ দৃশ্য স্পষ্টভাবে দেখা যাবে।
সূর্যগ্রহণ দেখার সময় অবশ্যই সোলার গ্লাসেস বা পিনহোল প্রজেক্টর ব্যবহার করতে হবে। তা না হলে সূর্যের দিকে সরাসরি তাকালে চোখের ক্ষতি হতে পারে।
জুন ২৬: চাঁদ এবং বুধ গ্রহের মিলন
২০২৫ সালের ২৬ জুন বুধ গ্রহ এবং চাঁদ একত্রে আকাশে উপস্থিত হবে। সাধারণত, বুধ সূর্যের খুব কাছাকাছি থাকার কারণে এই গ্রহটিকে দেখা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে, এই দিনটিতে বুধ চাঁদের কাছাকাছি এসে এটি একটি দুর্দান্ত দৃশ্য তৈরি করবে। সূর্যাস্তের পর, চাঁদের পাতলা অর্ধচন্দ্রের পাশে বুধকে ক্ষীণ আলোর মতো দেখা যাবে।
আগস্ট ১২: ভেনাস এবং বৃহস্পতির কাছে আসা
১২ আগস্ট ২০২৫, ভেনাস এবং বৃহস্পতি একে অপরের কাছাকাছি আসবে এবং এক বিরল মহাকাশীয় দৃশ্য তৈরি করবে। সূর্যোদয়ের সময় পূর্ব আকাশে, এই দুটি গ্রহ এত কাছাকাছি অবস্থান করবে যে তা খালি চোখে সহজেই দেখা যাবে। ভেনাস তার উজ্জ্বল সাদা আলো দিয়ে বৃহস্পতিকে ছাড়িয়ে যাবে। এই সময় বৃহস্পতির আকাশমণ্ডল এবং তার চারটি গ্যালিলিওন চাঁদও ছোট ছোট বিন্দুর মতো স্পষ্ট দেখা যাবে।
সেপ্টেম্বর ৭: পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ এবং ব্লাড মুন
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে, পৃথিবী আবার চাঁদের উপর তার ছায়া ফেলবে এবং দ্বিতীয়বারের মতো ব্লাড মুনের দৃশ্য দেখার সুযোগ পাবে পৃথিবীবাসি। দিনটিতে পৃথিবীর ধূলিময় বায়ুমণ্ডলের মাধ্যমে সূর্যের আলো বেঁকে গিয়ে চাঁদের পৃষ্ঠে পড়বে। যার ফলে চাঁদ রক্তলাল আভা ধারণ করবে। এই বিশেষ ঘটনা ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দেখা যাবে।
সেপ্টেম্বর ১৯: চাঁদ, ভেনাস এবং রেগুলাসের আকাশগঙ্গায় মিলন
২০২৫ এর ১৯ সেপ্টেম্বর, একটি চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে যাচ্ছে বিশ্ববাসী। পূর্ব আকাশে সূর্যোদয়ের কিছু আগে, চাঁদের পাতলা অর্ধচন্দ্র, উজ্জ্বল ভেনাস এবং রেগুলাস গ্রহ একত্রিত হয়ে আকাশকে সাজাবে ত্রিভুজ আকৃতিতে।
ভেনাস তার উজ্জ্বল সাদা আলোতে ঝলমল করবে। আর রেগুলাস একটি নীল-সাদা আভায় দ্যুতি ছড়াবে। দৃশ্যটি খুবই মনোমুগ্ধকর হতে চলেছে এবং সহজেই খালি চোখে দেখা যাবে এ অপরূপ দৃশ্য।
নভেম্বর ৮: শনি গ্রহের বলয় অদৃশ্য হয়ে যাবে
সময়টি ৮ নভেম্বর ২০২৫। একটি অত্যন্ত বিরল দৃশ্য ঘটতে যাচ্ছে মহাকাশে। যখন শনি গ্রহের বলয় প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাবে। এই বিশেষ ঘটনা ঘটবে যখন শনি গ্রহের অক্ষ সূর্য এবং পৃথিবীর সোজা একই লাইনে চলে আসবে।
এটি এক ধরণের “অ্যানালেমা” বা “ring plane crossing”, যা প্রতি ১৫ বছরে একবার ঘটে। শনি গ্রহের বলয়গুলোর এক পৃষ্ঠ পৃথিবীর সাথে সোজা অবস্থানে থাকার কারণে তাদেরকে প্রায় অদৃশ্য মনে হবে। এই বিরল দৃশ্যটি পৃথিবী থেকে টেলিস্কোপ ব্যবহার করে স্পষ্টভাবে দেখা যাবে।
ডিসেম্বর ১৩ থেকে ১৪: জেমিনিড মিটিওর ঝর্ণা
২০২৫ সালের ১৩ থেকে ১৪ ডিসেম্বর এর মধ্যে জেমিনিড মিটিওর ঝর্ণা তার শিখরে পৌঁছাবে। এটি মূলত একটি উল্কাপাতের ঝর্ণা, যা একটি অত্যন্ত চমকপ্রদ মহাকাশীয় ঘটনা। প্রতি বছরই এই ঝর্ণা ঘটে, তবে ২০২৫ সালে এটি আরও বিশেষ হবে। কারণ, এ সময়টিতে চাঁদের আলো কম থাকার কারণে উল্কাপাতের দৃশ্য আরো স্পষ্ট এবং সুন্দর হয়ে উঠবে। এই ঝরনায় প্রতি ঘণ্টায় ৬০ থেকে ১২০টি উল্কাপাত দেখা যাবে, যা আকাশে এক ধরনের বিশেষ আলোক ঝলকানি সৃষ্টি করবে।
২০২৫ সালের অরোরা
২০২৫ একটি বিশেষ সাল। এ বছর সূর্যের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে, পৃথিবীর আকাশে একটি অসাধারণ এবং শক্তিশালী অরোরা দেখা যাবে। যা আকাশপ্রেমীদের জন্য নিঃসন্দেহে একটি দারুণ অভিজ্ঞতা হতে চলেছে । সূর্য গ্রহের (solar flare) এবং সূর্য স্পর্শের (coronal mass ejection) কারণে এই অলৌকিক আলোর খেলা বা ‘ অরোরা’ আরও উজ্জ্বল এবং রঙিন হয়ে উঠবে। চমকপ্রদ দৃশ্যটি পৃথিবীর মেরু অঞ্চলে বিশেষভাবে দৃশ্যমান হবে।
আসলে, অরোরা হলো একটি প্রাকৃতিক আলো শিখা, যা পৃথিবীর মেরু অঞ্চলে ঘটে থাকে। সূর্য থেকে নির্গত শক্তিশালী আহিত কণিকা যখন পৃথিবীর চুম্বক ক্ষেত্রের সঙ্গে সংযোগ ঘটায়, ঠিক তখন আকাশে এই রঙিন আলোর ঝলকানি দেখা যায়। যাকে বলা হয় অরোরা।
২০২৫ সালে সূর্যের কার্যকলাপের বৃদ্ধি এই আলোর খেলাকে আরও উজ্জ্বল এবং আরও বিস্ময়কর করে তুলবে। বিশেষ করে, আকাশে সবুজ, লাল, নীল এবং বেগুনি রঙের আলো এক অভূতপূর্ব দৃশ্য তৈরি করবে।
এই প্রাকৃতিক আলোর খেলা প্রধানত উত্তর মেরু (Aurora Borealis) এবং দক্ষিণ মেরু (Aurora Australis) অঞ্চল থেকে সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। তবে, ২০২৫ সালের শক্তিশালী অরোরা দক্ষিণের অঞ্চলগুলো, যেমন কানাডা, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, আলাস্কা এছাড়াও অন্যান্য উচ্চ অক্ষাংশ এলাকায়ও দেখা যেতে পারে।
২০২৫- হবে আকাশপ্রেমীদের জন্য এক অদ্বিতীয় বছর। সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, ব্লাড মুন, গ্রহীয় মিলন, শনি গ্রহের বলয় অদৃশ্য হওয়া সহ এমন অনেক মহাকাশীয় ঘটনা ঘটবে যা আকাশপ্রেমীদের মন্ত্রমুগ্ধ করতে এক চুলও ছাড় দেবে না। প্রতিটি দৃশ্যই নতুন নতুন রহস্য উন্মোচন করবে। তাই আকাশপ্রেমীরা প্রস্তুত হোন, মহাকাশের দিকে তাকিয়ে এই অভিজ্ঞতার সামিল হতে আর বেশি দেরি নেই!
রেফারেন্সঃ