স্ট্যান লি যখন প্রথম সুপারহিরো চরিত্রগুলোর ভাবনা মাথায় আনেন, তখন হয়তো তিনিও ভাবেননি যে একদিন এই চরিত্রগুলো গোটা পৃথিবীর মানুষের জীবনকে স্পর্শ করবে। কমিক বুকের পাতা থেকে শুরু হয়ে হাজারো বাধা পেরিয়ে ক্যামেরার সামনে উঠে সুপারহিরো সিনেমার জগতকে বদলে দেবে এক রূপকথার মতো।
সুপারহিরো মানেই আজ চোখে ভেসে ওঠে সুপারম্যান, ব্যাটমান, আয়রন ম্যান, থর, ক্যাপ্টেন আমেরিকা কিংবা স্পাইডার-ম্যানের ছবি। এই সব চরিত্র শুধু সিনেমার পর্দায় নয়, জায়গা করে নিয়েছে আমাদের মনেও। আর এই চরিত্রগুলো মার্ভেল আর ডিসির মত কমিক বইয়ের জগৎ থেকে উঠে এসেছে সিনেমার পর্দায়।
তবে সিনেমার পর্দায় আয়রনম্যান, স্পাইডারম্যান ক্যাপ্টেন আমেরিকার মত মার্ভেল কোম্পানির সুপারহিরোদের নিয়ে গড়া এক অসাধারণ সিনেম্যাটিক জগতের নাম হলো মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্স সংক্ষেপে MCU।
মার্ভেল ইউনিভার্স আসলে শুধু সুপারহিরোদের গল্প নয়। এটা কমিক বুকের পাতা ছেড়ে রেড কার্পেট, থিয়েটার আর দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়া কিছু কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে এক বিশাল জহৎ। এই জগৎ স্ট্যান লি নামের এক কল্পনাপ্রবণ মানুষের কমিক বইয়ের পাতায় আঁকা চরিত্র থেকে শুরু করে শত কোটি ডলারের ইন্ডাস্ট্রি হয়ে ওঠার এক মহাকাব্যিক যাত্রা।
এই বিশাল জগতের জন্ম, বিকাশ আর বর্তমান নিয়েই আমাদের এই গল্প।
স্ট্যান লি ও মার্ভেল কমিক্সের সূচনা
আজকে আমরা যে মার্ভেল ইউনিভার্স দেখি, তার গোড়ার গল্পটা শুরু হয়েছিল একদমই সাধারণভাবে। ১৯৩৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে Timely Publications নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা যাত্রা শুরু করে।
এই টিমলির প্রথম দিকের কমিক চরিত্র ছিল হিউম্যান টর্চ ও নেমর দ্য সাব-মেরিনার। পরে, ১৯৬১ সালে টিমলি রূপ নেয় Marvel Comics-এ। আর এখান থেকেই শুরু হয় এক নতুন যুগ যা কমিক বুক ইন্ডাস্ট্রির ধারাই বদলে দেয়।
এই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় কারিগর ছিলেন এক তরুণ ও কল্পনাপ্রবণ মানুষ স্ট্যান লি। তার সঙ্গে ছিলেন শিল্পী জ্যাক কিরবি ও স্টিভ ডিটকো। তারা মিলে এমন কিছু সুপারহিরো চরিত্র তৈরি করলেন, যাদের শুধু অতিমানবিক শক্তি ছিল না, ছিল মানবিক দুর্বলতাও।
১৯৬১ সালে ফ্যান্টাস্টিক ফোর-এর মাধ্যমে শুরু হয় এই নতুন ঢেউ। তারা ছিল একদল বিজ্ঞানী যারা মহাকাশে গিয়ে রশ্মির প্রভাবে বিশেষ শক্তি লাভ করে। এরপর একে একে জন্ম নিল হাল্ক, থর, আয়রন ম্যান, স্পাইডার-ম্যান, ডক্টর স্ট্রেঞ্জ, ডেয়ারডেভিল এবং এক্স-ম্যান।
এই চরিত্রগুলো ভিন্ন ছিল কারণ, এরা নিখুঁত ছিল না। স্পাইডার-ম্যান ছিল এক কিশোর যার পরীক্ষার চিন্তা, প্রেমের জটিলতা আর অপরাধবোধ ছিল। আয়রন ম্যান ছিল বিলিয়নিয়ার টনি স্টার্ক যিনি নিজের মনেই দ্বন্দ্বে ভরা এক প্রযুক্তিবিদ।
স্ট্যান লি-র মূল দর্শন ছিল, হিরো মানেই যে সবসময় সঠিক, তা নয়। হিরোও ভুল করে, ভয় পায়, পরাজিত হয় এবং আবার উঠে দাঁড়ায়। তার এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিই পাঠকদের সঙ্গে সুপারহিরোদের একটি মানসিক সংযোগ গড়ে দেয়।
তাদের এই চিন্তা-ভাবনা আর নতুন ধারা মার্ভেল কমিক্সকে দারুণ জনপ্রিয় করে তোলে ১৯৬০-এর দশক থেকে। DC কমিকস যেখানে নিখুঁত সুপারহিরো দেখাত, মার্ভেল দেখাল মানুষের মতো হিরো, যারা হঠাৎ শক্তি পেয়ে কিংবা জীবনের চাপে পড়ে হিরো হয়ে ওঠে।
স্ট্যান লি শুধু লেখক ছিলেন না, তিনি ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি বুঝেছিলেন কমিকস শুধু শিশুদের জন্য নয়, বরং সব বয়সের মানুষের জন্যও হতে পারে। তার লেখা ডায়ালগ, গল্পের বাঁক, চরিত্রের আবেগ সব মিলিয়ে একটি নতুন সাহিত্যিক ধারা তৈরি হয়।
এইভাবেই জন্ম নেয় সেই সুপারহিরো দল, যারা এখন কমিক বই পেরিয়ে সিনেমা, গেমস, খেলনা, এমনকি থিম পার্ক পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে।
কমিক থেকে সিনেমার পথে: ব্যর্থতা ও শিক্ষা
কমিকসের পাতায় রাজত্ব করা মার্ভেল চরিত্রগুলোকে বড় পর্দায় দেখার স্বপ্ন অনেক পুরনো। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে মার্ভেলকে প্রথমে হোঁচট খেতে হয়েছিল অনেকবার।
১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে, মার্ভেল নানা স্টুডিওর সঙ্গে মিলে কিছু সিনেমা বানানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ফল খুব একটা ভালো হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় “হাওয়ার্ড দ্য ডাক” (1986) আর “ক্যাপ্টেন আমেরিকা” (1990) এই সিনেমাগুলো দর্শকের মন জয় করতে পারেনি, বরং সমালোচনার মুখে পড়ে। কারন, বাজেট ছিল সীমিত, স্পেশাল ইফেক্ট ছিল দুর্বল আর গল্পগুলো কমিকের চিরচেনা গভীরতা বহন করতে পারেনি।
এই সময়টায় মার্ভেল নিজেরা সিনেমা বানানোর মতো আর্থিক বা প্রযোজনাগত সক্ষমতা রাখত না। তাই তারা নিজেদের সুপারহিরো চরিত্রগুলোর মুভি রাইটস বিভিন্ন বড় স্টুডিওকে বিক্রি করে দেয়। যেমন স্পাইডার-ম্যান চলে যায় Sony-এর কাছে, এক্স-ম্যান ও ফ্যান্টাস্টিক ফোর চলে যায় 20th Century Fox-এর হাতে আর ব্লেড সিনেমা আসে New Line Cinema-এর ব্যানারে।
এর ফলে, একদিকে মার্ভেল নিজেদের জন্য কিছু অর্থ আনলেও তারা তাদের নিজস্ব চরিত্রগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। গল্প কী হবে, কোন অভিনেতা অভিনয় করবে, কোনভাবে চরিত্র উপস্থাপন করা হবে সবই তখন নির্ধারিত হতো বাইরের স্টুডিওদের হাতে।
তবে, এখানেই মার্ভেল বুঝতে পারল এক গুরুতর বিষয়। যদি তারা নিজেরাই সিনেমা প্রযোজনা করে, তাহলে গল্প, চরিত্র ও স্বপ্ন সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখা যাবে। আর এই নিয়ন্ত্রণই হতে পারে তাদের ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
এই সময়েই তারা দেখতে পেল স্পাইডার-ম্যান বা এক্স-ম্যান সিরিজের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা, কিন্তু লাভের বড় অংশ চলে যাচ্ছে অন্যদের পকেটে। এটা ছিল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া, যে সময় এসেছে নিজের স্টুডিও গড়ার।
এই ব্যর্থতাগুলোই পরিণত হয় মার্ভেলের বড় শিক্ষা ও শক্তিতে। তারা বুঝতে পারল, সিনেমার জগতে টিকে থাকতে হলে শুধু কমিকের জনপ্রিয়তা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন পরিকল্পনা, প্রযোজনা আর নিজেদের হাতে গল্প বলার স্বাধীনতা।
এভাবেই শুরু হয় মার্ভেলের আসল যাত্রা। নিজের ঘরেই নিজের সিনেমা তৈরি করার, যেটা একদিন হয়ে উঠে মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্স। শুরুতেই ব্যর্থতা ছিল, কিন্তু সেই ব্যর্থতাই হয়ে উঠল ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় জ্বালানি।
মার্ভেল স্টুডিওর উত্থান ও এমসিইউ’র জন্ম
সব ব্যর্থতা ও শিখনপাঠ শেষে মার্ভেল বুঝতে পারল নিজেদের চরিত্র নিয়ে সিনেমা বানাতে হলে, গল্পের উপর নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই ২০০৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে Marvel Studios। এটিই ছিল মার্ভেলের ইতিহাসে এক গেম-চেঞ্জিং সিদ্ধান্ত।
তখন মার্ভেলের হাতে বড় কোনো বাজেট ছিল না। এমনকি তারা কিছু জনপ্রিয় চরিত্রের স্বত্বও হারিয়ে ফেলেছিল। স্পাইডার-ম্যান, এক্স-ম্যান বা ফ্যান্টাস্টিক ফোর তখন অন্য স্টুডিওর অধীনে। তাই তারা বেছে নেয় এমন এক চরিত্র, যাকে নিয়ে আগে কখনো কোনো বিখ্যাত সিনেমা হয়নি, আয়রন ম্যান।
২০০৮ সালে মুক্তি পায় Marvel Studios-এর প্রথম সিনেমা “Iron Man”, পরিচালনায় জন ফ্যাভরু। আর টাইটেল চরিত্রে রবার্ট ডাউনি জুনিয়র। রবার্ট নিজেও তখন পেশাগতভাবে কিছুটা পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু এই সিনেমাই বদলে দেয় সবকিছু।
“আয়রন ম্যান” ছিল মার্ভেলের এক সাহসী বাজি। আর সেই বাজিতে তারা বাজিমাত করে ফেলে । দুর্দান্ত অভিনয়, বাস্তবসম্মত ভিএফএক্স আর হিউমার ও অ্যাকশনের নিখুঁত ভারসাম্য এনে দেয় বিশাল সাফল্য। বিশ্বজুড়ে দর্শকরা অভিভূত হয় নতুন এক সুপারহিরো স্বাদের সিনেমায়।
কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি মার্ভেল। এই সিনেমার শেষ ক্রেডিটের পর স্ক্রিনে আসেন নিক ফিউরি (স্যামুয়েল এল. জ্যাকসন) এবং বলেন,
“I’m here to talk to you about the Avengers Initiative.”
এই একটি লাইন বদলে দিল সুপারহিরো সিনেমার ভবিষ্যৎ। এখানে প্রথমবারের মতো দর্শকরা বুঝতে পারল এগুলো একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে এবং সামনে আরও বড় কিছু আসছে।
এই কনসেপ্টের নাম দেয়া হয় মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্স (MCU)। এমসিইউ-র নেতৃত্বে ছিলেন এক দূরদর্শী প্রযোজক, কেভিন ফাইগি। তার মাথায় ছিল এক বিশাল ন্যারেটিভ প্ল্যান, যেটাকে বলা হয় Infinity Saga।
এই পরিকল্পনায় ধাপে ধাপে মুক্তি পায় “The Incredible Hulk”, “Thor”, “Captain America: The First Avenger” এবং সবশেষে “The Avengers” (2012) যেখানে সব সুপারহিরো এক গল্পে এক পর্দায় একসঙ্গে। এটা ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
Marvel Studios ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে এক মুভি মেশিন। শুধু সুপারহিরো নয়, প্রতিটি চরিত্র পায় নিজস্ব গল্প, আবেগ আর কনফ্লিক্ট। প্রত্যেক সিনেমার শেষে থাকতো এন্ড ক্রেডিট সিন। যেখান থেকে দর্শক পরে কি হবে তা নিয়ে এক রকমের উত্তেজনা অনুভব করতো। MCU এমন এক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে, যেখানে দর্শকরা এক সিনেমার সঙ্গে পরের সিনেমাকে যুক্ত করতে থাকে এবং একটা বিশাল জগতে হারিয়ে যায়।
২০০৮ থেকে শুরু করে ২০১৯ সালের Avengers: Endgame পর্যন্ত, মার্ভেল সৃষ্টি করে ২৩টি সিনেমার এক জগৎ, যার নাম Infinity Saga। আর এই পুরো যাত্রার শুরু হয় সেই একটিমাত্র সাহসী পদক্ষেপ “Iron Man” দিয়ে।
এইভাবেই মার্ভেল শুধু সিনেমাই বানায়নি, তারা তৈরি করে একটা অভিজ্ঞতা যা সিনেমার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে।
মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের শুরুর ৩টি ফেজ: পরিকল্পনা ও এক্সিকিউশন
মার্ভেল স্টুডিও যখন “Iron Man” দিয়ে যাত্রা শুরু করে, তখন তারা জানত এটা শুধু একটি সিনেমা নয়, বরং শুরু হচ্ছে এক মহাযাত্রা। এই যাত্রার গতি ও কাঠামো ঠিক রাখতে তারা পুরো প্ল্যানকে ভাগ করে তিনটি বড় ফেজে (Phase)। প্রতিটি ফেজে ছিল আলাদা থিম, লক্ষ্য এবং চরিত্রদের নির্মাণ ও বিকাশের ধাপ।
Phase 1 (২০০৮–২০১২): ভিত্তি নির্মাণ
এই ফেজটি ছিল MCU-র মূল ভিত্তি। এখানে মার্ভেল পরিচয় করিয়ে দেয় একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। Iron Man (2008) যেখান থেকে সব শুরু। পরিচয় করানো হয় প্রযুক্তিনির্ভর সুপারহিরো টনি স্টার্কের। এরপর The Incredible Hulk (2008) যেখানে দেখানো হয় হাল্ক চরিত্রের নতুন রূপায়ন। এরপর আসে Iron Man 2 (2010) যেখানে টনির চরিত্র আরও গভীর হয়, আর দেখা যায় ব্ল্যাক উইডোকে। পরবর্তীতে Thor (2011) দিয়ে মার্ভেল জগতে ঢুকে পড়ে নর্স মাইথলজি। আসে থর, লকি ও অ্যাসগার্ডের পরিচয়। তারপর, Captain America: The First Avenger (2011) দিয়ে ১৯৪০-এর দশকের পটভূমিতে এক দেশপ্রেমিক সৈনিকের সুপারহিরো হয়ে ওঠার গল্প।
The Avengers (2012) ছিল MCU-র প্রথম ক্লাইম্যাক্স। সব হিরো একসাথে প্রথমবারের মতো স্ক্রিন শেয়ার করে। লোকি এখানে প্রধান ভিলেন। পোস্ট ক্রেডিটে দেখানো হয় ইনফিনিটি সাগার মূল ভিলেন থানোসকে। দর্শকরা প্রথমবার বুঝে যায়, MCU কেবল সিনেমার সিরিজ নয়, এটা এক বিশাল সংযুক্ত জগৎ।
এই ফেজে মার্ভেল দেখিয়ে দেয় “origin story”-এর পরেও একটি বড় ন্যারেটিভ সম্ভব, যেখানে সব চরিত্র মিলিত হয় একটি জগতে।
Phase 2 (২০১৩–২০১৫): প্রসার ও গভীরতা
ফেজ ১-এর সফলতার পর মার্ভেল নতুন রকমের গল্প বলায় মন দেয়। গল্পগুলো আরও গভীর, রঙিন ও বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে।
Iron Man 3 (2013), Thor: The Dark World (2013), Captain America: The Winter Soldier (2014) দিয়ে মূল চরিত্রগুলোকে দেয়া হয় গভীরতা।
Avengers: Age of Ultron (2015) ছিল দ্বিতীয় অ্যাভেঞ্জার্স মুভি। আসে নতুন ভিলেন আল্ট্রন আর নতুন হিরো স্কারলেট উইচ, ভিশন। আর সাথে আবার সেই থানোসের ঝলক।
এই ফেজেই আসে Ant-Man (2015) এবং Guardians of the Galaxy (2014) যারা একদম নতুন চরিত্র। যেগুলো এভেঞ্জার্স সিরিজে তখনও যুক্ত করা হয় নি।
এই ফেজে মার্ভেল একদিকে তাদের গল্পকে বিস্তৃত করে মহাকাশ ও রাজনীতিতে। আরেকদিকে হিউমার, আবেগ ও অ্যাকশনের ভারসাম্য বজায় রাখে।
Phase 3 (২০১৬–২০১৯): দ্বন্দ্ব, ভাঙন ও মহাসংঘর্ষ
এই ফেজে MCU তার সবচেয়ে পরিণত রূপ পায়। হিরোদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, নতুন মুখ এবং এক বিশাল ক্লাইম্যাক্স এই ফেজের বৈশিষ্ট্য। ছোটখাট এভেঞ্জার্সই ছিল Captain America: Civil War (2016)। হিরো বনাম হিরো। টিম টনি বনাম টিম স্টিভ। এরকম দ্বৈরথ খুব কমই দেখা যায়।
পরবর্তীতে ম্যাজিক নিয়ে আসে Doctor Strange (2016), Guardians of the Galaxy Vol. 2 (2017)। সাথে, Spider-Man: Homecoming (2017) দিয়েস্পাইডার-ম্যান অবশেষে মার্ভেল ইউনিভার্সে প্রবেশ করে। Thor: Ragnarok (2017), Black Panther (2018) আনে নতুন বৈচিত্র্য।
Avengers: Infinity War (2018) দিয়ে হয় থানোসের আবির্ভাব। হিরোরা পরাজিত হয়, অনেকেই ‘ধুলায়’ মিশে যায়। শেষ হয় এক ভয়াবহ ক্লিফহ্যাঙ্গারে।
তারপর, Ant-Man and the Wasp (2018) দিয়ে আনা হয় কোয়ান্টাম রিয়ালিটির ইঙ্গিত এবং টাইম ট্রাভেলের সম্ভাবনা ও প্রস্তুতি। সাথে, Captain Marvel (2019) দিয়ে যাত্রা শুরু করে MCU-র প্রথম নারী-কেন্দ্রিক মুভি।
Avengers: Endgame (2019) দিয়ে হয় এক যুগের সমাপ্তি। টাইম ট্রাভেল, পুরনো সিনেমার সঙ্গে সংযোগ, এবং নাতাশা ও টনির আত্মত্যাগ MCU-র সবচেয়ে আবেগময় মুহূর্ত এনে দেয়।
এই ফেজের মাধ্যমে মার্ভেল শুধু নিজের সিনেমাগুলোকে এক করেনি, বরং একটি বিশাল গল্পজগত তৈরি করেছে, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক অবিস্মরণীয় গল্পভাণ্ডার হয়েছে।
তিনটি ফেজে মার্ভেলের সফলতার পেছনে মূল কারণ ছিল:
- প্রতিটি চরিত্রকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া,
- বড় গল্পের মধ্যে ছোট ছোট গল্প বুনে ফেলা,
- এবং সব শেষে একসাথে সেগুলোকে যুক্ত করে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা তৈরি।
এই পরিকল্পনা ও এক্সিকিউশনের নিখুঁত সমন্বয়ই আজ MCU-কে করেছে বিশ্বসেরা ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর একটি।
স্ট্যান লি: এক কিংবদন্তির বিদায়
মার্ভেল ইউনিভার্সের পেছনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাম যদি একজনের কথা বলা হয়, তিনি নিঃসন্দেহে স্ট্যান লি। শুধুমাত্র একজন লেখক বা সম্পাদক নয়, তিনি ছিলেন এক সৃষ্টিশীল দৃষ্টিভঙ্গির জাদুকর। তার হাত ধরেই জন্ম নেয় স্পাইডার-ম্যান, আয়রন ম্যান, থর, হাল্ক, এক্স-ম্যান, ব্ল্যাক প্যান্থারসহ অসংখ্য সুপারহিরো।
১৯৬০-এর দশকে যখন কমিক বই শুধু শিশুদের মজার গল্প বলার মাধ্যম ছিল, তখন স্ট্যান লি একে রূপ দিলেন মানবিক সংকট, সামাজিক বার্তা আর নায়কোচিত সংগ্রামের প্ল্যাটফর্মে। তার তৈরি চরিত্রগুলো নিখুঁত ছিল না। তারা ভুল করত, কষ্ট পেত, ভালোবাসত। ঠিক যেমন বাস্তব মানুষরা করে। আর এখানেই তার জাদু।
স্ট্যান লির আরেকটি দারুণ দিক ছিল তার ক্যামিও উপস্থিতি। মার্ভেল সিনেমার প্রায় প্রতিটিতে ছোট্ট করে তাকে দেখা যেত কোনো না কোনো চরিত্রে। কখনও ডেলিভারি ম্যান, কখনও লাইব্রেরিয়ান, আবার কখনও রিক্রুটার। এই ছোট্ট দৃশ্যগুলো দর্শকের মুখে হাসি ফোটাত, আর মনে করিয়ে দিত যে এই মানুষটাই সব শুরু করেছিলেন।
২০১৮ সালে ৯৫ বছর বয়সে স্ট্যান লি আমাদের ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তিনি যা রেখে গেছেন, তা মৃত্যুহীন। তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো আজও আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়, আমাদের আনন্দ দেয়, আমাদের স্বপ্ন দেখায়।
আজকের MCU (Marvel Cinematic Universe), যার বিস্তার পৃথিবী থেকে মাল্টিভার্স পর্যন্ত, তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল স্ট্যান লির কল্পনা আর সাহসিকতা দিয়ে। তিনি শুধু মার্ভেলের নয়, গোটা পপ কালচারের ইতিহাসে একজন কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন।
স্ট্যান লি নেই, কিন্তু তার তৈরি পৃথিবটা আজও জীবন্ত। হলরুমে, কমিক পেইজে আর কোটি ভক্তের হৃদয়ে।
পোস্ট-এন্ডগেম মার্ভেল: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
Avengers: Endgame ছিল মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের (MCU) এক মহাকাব্যিক অধ্যায়ের শেষ। কিন্তু এই সমাপ্তি ছিল নতুন যুগের সূচনা, যেখানে পুরোনো সুপারহিরোর বিদায় নিয়ে আসে নতুন চরিত্র, নতুন জগৎ আর এক্সপেরিমেন্টাল গল্প বলার ধারা।
Phase 4 শুরু হয় Disney+ সিরিজ দিয়ে। যেখানে সিনেমার বাইরেও মার্ভেল ভক্তরা এক নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদ পায়। WandaVision, The Falcon and the Winter Soldier, Loki, Hawkeye এসব সিরিজ শুধু গল্পকে বাড়িয়ে দেয়নি, বরং চরিত্রগুলোর মানসিক দিক, ব্যক্তিগত সংগ্রাম আর নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
Loki সিরিজে মাল্টিভার্সের ধারণা দর্শকদের সামনে আসে এক নতুন বাস্তবতার মতো। একাধিক টাইমলাইন, বহু পৃথিবী এসব ধারণা ভবিষ্যতের সিনেমাগুলোর জন্য তৈরি করে অসীম কনটেন্টের সুযোগ। Doctor Strange in the Multiverse of Madness এবং Spider-Man: No Way Home এই মাল্টিভার্সের ধারণাকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে।
তবে শুধু পুরোনো চরিত্র নয়, পোস্ট-এন্ডগেম যুগে মার্ভেল আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় একদম নতুন হিরোদের সাথে। যেমন Shang-Chi তার নিজস্ব স্টাইল আর এশিয়ান কালচারের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে দর্শকের মন জয় করে। আবার Eternals একদল অসীম শক্তিধর চরিত্রের মাধ্যমে গল্পকে তুলে নিয়ে যায় আরও কসমিক মাত্রায়।
এই সময়েই মার্ভেল ঘোষণা দেয় X-Men ও Fantastic Four ফেরার কথা। একসময় যারা অন্য স্টুডিওর অধীনে ছিল, এখন তারা মার্ভেলের নিজস্ব ছাতার নিচে ফিরে আসছে। একদিকে দর্শকদের মধ্যে পুরোনো নস্টালজিয়া ফিরিয়ে আনা, অন্যদিকে নতুন করে গল্প বলার সুযোগ এই দুটি কারণে নতুন আগ্রহ তৈরি হচ্ছে।
তবে সব সম্ভাবনার মাঝেও কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। দর্শকের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে, আর পরপর এত কনটেন্ট মুক্তি পাওয়ায় কিছুটা ক্লান্তিও এসেছে। গল্পের গভীরতা, চরিত্রের মানসিক বিকাশ এবং ভিজ্যুয়াল কোয়ালিটির দিকেও বাড়তি মনোযোগ প্রয়োজন।
তবু, পোস্ট-এন্ডগেম মার্ভেল এক নতুন পরীক্ষার মঞ্চ। যেখানে কেবল সুপারহিরো নয়, বরং গল্প বলার নতুন রূপ, বৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিত্বই হয়ে উঠতে পারে তাদের পরবর্তী সাফল্যের চাবিকাঠি।
M’She’U বিতর্ক – অতিরিক্ত নারীকেন্দ্রিক প্রজেক্ট?
অনেকেই সমালোচনা করছেন, সাম্প্রতিক মার্ভেল প্রজেক্টগুলোতে অতিরিক্ত নারী চরিত্র জোর করএ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। “MSheU” বলে ব্যঙ্গও করা হচ্ছে। বিতর্কের শুরুটা হয় এভেঞ্জার্স এন্ডগেমে নারী সুপারহিরোদের ট্রিবিউট দিতে গিয়ে। যুদ্ধের সিরিয়াস মোমেন্টে সব নারী সুপারহিরোদের একত্রে এক সিনে হিরো ট্রিবিউট দিতে গিয়ে মোমেন্টাম নষ্ট করে। এরপর সিনেমাগুলোয় একের পর এক নারী সুপারহিরো এনে জেন্ডার নিউট্রালিটি দেখাতে গিয়ে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তাদের ফোকাস করে এই বিতর্ক আরও বড় করেছে।
আজকের শিশুদের কাছে যেমন আয়রন ম্যান বা স্পাইডার-ম্যান নায়ক, তেমনি বড়দের কাছেও এসব চরিত্র হয়ে উঠেছে একরকম আত্মার অংশ। শুধু বিনোদন নয়, MCU হয়ে উঠেছে সংযোগের ভাষা যা পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষকে একসাথে নিয়ে এসেছে।
এটি নিঃসন্দেহে স্ট্যান লি’র স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন। আর এই স্বপ্নযাত্রা এখনো চলছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, চরিত্র থেকে চরিত্রে, গল্প থেকে দর্শকের হৃদয়ে।
তথ্যসূত্র –
- https://archive.roar.media/bangla/main/book-movie/kevin-feiges-journey-of-mcu
- https://www.kishoralo.com/entertainment/17m6mrjnfx
- https://www.kishoralo.com/feature/jxe2d515mt
- https://www.mindonmap.com/bn/blog/marvel-movie-timeline/
- https://www.britannica.com/topic/list-of-films-in-the-Marvel-Cinematic-Universe
- https://www.cbr.com/mcu-reboot-inevitable/
- https://www.newyorker.com/magazine/2023/06/12/how-the-marvel-cinematic-universe-swallowed-hollywood
- https://cinemated4u.com/the-rise-of-marvel-studios-how-it-became-a-global-phenomenon/
- https://www.marvel.com/movies