Image default
নগর পরিচিতি

আফ্রিকার সবচেয়ে বড় ভাসমান গ্রাম- গ্যানভি

চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো- একটি গ্রাম যেখানে নেই কোনো মাটির পথ, নেই সবুজ মাঠ কিংবা দালান-কোঠার কোলাহল! আছে শুধু অথৈ পানি, আর সেই পানির বুকে ভাসমান অসংখ্য কাঠের ঘর! 

কখনো কি শুনেছেন এমন একটি গ্রামের কথা, যেখানে স্কুল, বাজার, হাসপাতাল, এমনকি পাশের বাড়ির ভাবির সাথে গল্প করতে গেলেও নৌকায় চেপে যেতে হয়! না, এটি কোনো কল্পনার জগৎ নয়। এটি বেনিনের লেক নোকুয়ের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত ‘গ্যানভি’- আফ্রিকার সবচেয়ে বড় ভাসমান গ্রাম ।

উপর থেকে দেখলে গ্যানভিকে মনে হতে পারে এ যেন এক পরীর দেশ। কিন্তু এই সৌন্দর্যের পেছনে লুকিয়ে আছে এক কঠিন ইতিহাস। আপনি কি প্রস্তুত এই জলমগ্ন শহরের গল্প জানতে? 

তাহলে, চলুন ডুব দেই গ্যানভির রহস্যময় জগতে!

গ্যানভির অবস্থান ও জনসংখ্যা

গ্যানভি হল আফ্রিকার বেনিনে অবস্থিত একটি ভাসমান গ্রাম। এটি কোটোনু শহরের কাছাকাছি লেক নোকুয়ের বুকে এই গ্রামটি ভেসে রয়েছে। প্রায় ২০,০০০ মানুষের বাস এই ভাসমান গ্রামে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের বসবাস গ্রামটিকে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় ভাসমান গ্রাম হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে। 

গ্রামটি প্রায় ৩,০০০ স্তম্ভযুক্ত বাড়ি (স্টিল্ট হাউস) নিয়ে গঠিত। বাড়িগুলো পুরো লেক জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এই বাড়িগুলো পানিতে উঁচু স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকায়, গ্রামটির দৃশ্য আরও চমকপ্রদ করে তুলেছে।

ম্যাপ

গ্যানভি গ্রামের ইতিহাস

আফ্রিকার সবচেয়ে বড় ভাসমান গ্রাম গ্যানভির ইতিহাস শুনলে মনে হবে যেন কোনো উপন্যাসের গল্প। ১৭ শতকের কথা, তখন আফ্রিকায় দাস ব্যবসা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। টোফিনু জনগোষ্ঠী নিজেদের বাঁচাতে এক অভিনব পথ বেছে নেয়। শত্রুর থেকে বাঁচতে তারা পানির উপরেই গ্রাম বানিয়ে ফেলে! 

কীভাবে তৈরি হলো গ্যানভি?

টোফিনু জনগোষ্ঠীর শত্রু ছিলো ‘ফন গোষ্ঠী’। ফন’রা বিশ্বাস করত যে, পানিতে পবিত্র আত্মা বা দানব বাস করে। এই বিশ্বাসের কারণে তারা পানিতে প্রবেশ করতে ভয় পেত। টোফিনুরা এই ভয়টাকে কাজে লাগিয়ে লেক নোকুয়ের উপর গ্রাম বানায়। আর এ গ্রামের নাম দেয় ‘গ্যানভি’, যার অর্থ “আমরা বেঁচে গেছি”।

গ্যানভি গ্রামটি তৈরি করার জন্য টোফিনু জনগোষ্ঠীকে বেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হয়েছিল। লেক নোকুয়ের গভীরতা মাত্র ২ মিটার (৬ ফুট)। তারা স্থলভাগ থেকে মাটি এনে হ্রদে ভরাট করে ছোট ছোট দ্বীপ তৈরি করে। তারপর সেগুলোর উপর বাড়ি, স্কুল, বাজার এমনকি হাসপাতালও বানায়। 

গ্যানভি গ্রাম নিয়ে রূপকথার গল্প

লোকমুখে গ্যানভি গ্রামটি নিয়ে রূপকথার মতো অনেক গল্প শোনা যায়। এই গল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো টোফিনু রাজার কাহিনী। কথিত আছে, রাজা জানতেন যে ফন যোদ্ধারা জল বা জল আত্মাকে ভয় পায়। এই ভয়টাকে কাজে লাগিয়ে তিনি তার লোকদের বাঁচানোর এক অভিনব পরিকল্পনা করেন। লোকমুখে শোনা যায়, রাজা একটি ঈগলে পরিণত হয়ে একটি হ্রদ খুঁজতে বের হন। এরপর তিনি খুঁজে পান ‘লেক নোকুয়ে’, সেখানে পৌঁছে তিনি একটি বিশাল কুমিরে রূপ নেন এবং তার লোকদের নিরাপদে এই লেকে নিয়ে আসেন।

লোককাহিনী হলেও এটা সত্যি যে টোফিনু লোকেরা লেক নোকুয়ের উপর গ্রাম বানিয়ে শত্রুদের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। আজও গানভি গ্রামটি সেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং এটি দেখতে সত্যিই অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর।

গ্যানভি গ্রামের জীবনযাত্রা

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গ্যানভির মানুষের জীবন জলের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাদের ঘরবাড়িগুলো তৈরি করা হয়েছে কাঠের খুঁটির উপর। গ্রামটির যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা। বাজার থেকে স্কুল, রেস্তোরাঁ থেকে হাসপাতাল সবকিছুই পানির উপর ভাসমান। চারদিকে শুধু পানি আর পানি, আর এই পানিই তাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।

গ্যানভি গ্রামের ডিঙ্গি নৌকা ও ভাসমান ঘরবাড়ি

মাছ চাষ

গ্যানভির মানুষের প্রধান পেশা হলো মাছ চাষ। কিন্তু এটা কোনো সাধারণ মাছ চাষ নয়। এখানে তারা এক অভিনব প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে। স্থানীয় ভাষায় এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘আঁকাযা’। এই পদ্ধতিতে তারা পানির নিচে বাঁশ পুঁতে কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ বন তৈরি করে। এই বন হচ্ছে মাছের জন্য আদর্শ আবাসস্থল। আবার এর দ্বারা পরিবেশেরও কোনো ক্ষতি হয় না। এতে একদিকে যেমন মাছের উৎপাদন বাড়ে, তেমনি অন্যদিকে প্রকৃতির সাথেও তাদের সম্পর্ক গভীর হয়।

গ্যানভি গ্রামে আঁকাযা পদ্ধতিতে মাছ চাষ

মাছ থেকে পর্যটন

গ্যানভি গ্রামেটির অর্থনীতি মূলত মাছ ধরা এবং মাছ চাষের উপর নির্ভরশীল। তবে গ্যানভি এখন একটি সমৃদ্ধ পর্যটন শিল্পও গড়ে তুলেছে। পর্যটকরা এখানে আসেন অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ভাসমান বাজার এবং অনন্য জলপথ দেখতে। পর্যটন খাতের চাহিদা মেটাতে গ্যানভি অবকাঠামোগত উন্নয়নেও বিনিয়োগ করেছে। যেমন, নৌকা ট্যাক্সি চালু করা এবং শিশুদের হাঁটা শেখার জন্য কৃত্রিম জমি তৈরি করা ইত্যাদি।

গ্যানভি গ্রামের ভাসমান বাজার

জলের উপর জীবন

গ্যানভির মানুষরা তাদের জলজ জীবনযাত্রায় অভিযোজিত হয়েছে অসাধারণ উপায়ে। তারা জলে জন্মানো বিশেষ গাছপালা দিয়ে হ্যাট, ব্যাগ এবং আফ্রিকান অলঙ্কারের মতো জিনিস তৈরি করে। তাদের জীবনযাত্রা এতটাই অনন্য যে, এটি বিশ্বের অন্য কোনো সম্প্রদায়ের সাথে তুলনা করা যাবে না।

গ্যানভি: পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্য

প্রতিদিন ১০,০০০ এরও বেশি পর্যটক এই অনন্য গ্রামটি দেখতে আসেন, যা গানভিকে বেনিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে একটি করে তুলেছে। গানভি শুধু একটি গ্রাম নয়, এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস এবং সংস্কৃতির প্রতীক। গ্রামটিকে ১৯৯৬ সালের ৩১ অক্টোবর ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ টেন্টেটিভ লিস্টে (সাংস্কৃতিক বিভাগে) যুক্ত করা হয়।

আফ্রিকার ভেনিস

অনেকেই গানভিকে “আফ্রিকান ভেনিস” বলে ডাকেন। অবশ্য যারা কখনও ভেনিসে যাননি তারাই এমন নাম দিয়েছেন বলে মনে হয়! ভাসমান ছোট ছোট ঘর, সংকীর্ণ জলপথ, নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বয়ে চলা ডিঙ্গি নৌকাগুলো। সব মিলিয়ে গ্রামটি যে অপুর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য তৈরি করে, এর জন্য একে আফ্রিকার ভেনিস’ উপাধি দেয়া ভুল হবে না।

গ্যানভি গ্রামে কিভাবে যাবেন

প্রথমে কোটোনু সিটি সেন্টার থেকে ইগলিস সেন্ট মিশেল। সেখান থেকে, মোটর-ট্যাক্সি বা বুশ ট্যাক্সি নিয়ে ক্যালাভি ঘাটে পৌঁছাতে পারেন। সেখান থেকে ‘পিরোগে’ নামের ঐতিহ্যবাহী কাঠের নৌকায় চড়ে গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু হয়। 

সেখানে পৌঁছে একটি ছোট কাঠের শ্যাকের মতো অফিসে টিকিট কাটতে হবে। টিকিট কাটার সময় আপনাকে বেছে নিতে হবে ঐতিহ্যবাহী কাঠের রো-বোট নেবেন, নাকি ইঞ্জিন চালিত বড় নৌকা। রো-বোটে যাত্রাটা একটু বেশি রোমাঞ্চকর এবং প্রামাণিক অভিজ্ঞতা দেবে।

গ্যানভি গ্রামের রো-বোট

ঘাটের কর্মব্যস্ততা এবং যাত্রা শুরু

ঘাটের চারপাশে স্থানীয় লোকজনের যাতায়াত আর কর্মব্যস্ততা দেখে মনে হবে, এখানে সব সময়ই কিছু না কিছু চলছে। নৌকায় চড়ে গানভির দিকে যাত্রা শুরু করলে পথে দেখা মিলবে মাছ ধরার নৌকা আর সবুজ গাছপালার দৃশ্য। একটু পরেই চোখে পড়বে গানভির দিকে। 

গ্যানভির জীবন্ত দৃশ্য

গানভি গ্রামটি এবশ প্রাণবন্ত এবং চিত্রল। মাছ ধরার লোকেরা তাদের কাজে ব্যস্ত, মহিলারা আনারস নিয়ে যাচ্ছেন, শিশুরা খেলছে, আর নৌকাগুলো জলপথ দিয়ে চলাচল করছে। পুরো দৃশ্যটি যেন এক জীবন্ত ছবি। গ্রামে একটি ছোট গেস্টহাউসও আছে। ভাবলে মনে হয়, সেখানে এক রাত কাটালে অভিজ্ঞতাটা আরও স্মরণীয় হতো। তবুও, গানভি এমন একটি জায়গা যা দেখার পর মনে হয়, পৃথিবীতে এমন কিছু জায়গাও আছে! 

ভুডু মন্দির এবং ফেরার পথ

তীরে ফিরে আসার পথে একটি ভুডু মন্দির চোখে পড়তে পারে, যা মূলত জলের উপর বসবাস না করা লোকদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য স্থাপন করা হয়েছে। কোটোনুতে ফেরার পথে স্থানীয় বাজারের কিছু ছবি তুলে নিতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে একটু সতর্ক থাকুন, ছবি তুলতে দেখলেই অনেক স্থানীয় টাকা চাইতে পারে। 

অনেক পর্যটকের জন্য, গানভি এবং বেনিনের ‘ভুডু সংস্কৃতি’ এই দেশে আসার প্রধান আকর্ষণ।

ভুডু মন্দির

আফ্রিকার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মানুষের সহনশীলতার একটি জীবন্ত নিদর্শন এই গ্রাম ‘গানভি’। যদিও বিশ্বের অন্যান্য অংশেও এমন পানিবন্দি গ্রাম রয়েছে, যেমন ঘানার নজুলেজো। তবুও গানভি আফ্রিকার একটি অনন্য এবং গোপন পর্যটন রত্ন হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্যানভির চেহারা বদলে যাচ্ছে। পর্যটকদের ভিড়ে এখানকার ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঘরগুলোর জায়গা নিচ্ছে কংক্রিটের বাড়ি। পানি দূষণ এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে স্থানীয় মানুষ এবং সরকারকে একসাথে কাজ করতে হবে। গ্যানভি যদি হারিয়ে যায়, তাহলে আমরা শুধু একটি গ্রামই হারাব না, হারাব একটি জীবন্ত সভ্যতা।

তথ্যসূত্র 

Related posts

পার্থ: সোনালী সৈকতের রঙিন শহর

শেখ আহাদ আহসান

কায়রো – প্রাচীন কোলাহলের শহর

মুম্বাই – মেরি জান

আবু সালেহ পিয়ার

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More