“তাদের হাতেই যুদ্ধ ও শান্তির চাবিকাঠি !”
ব্যাংকিং, বিনিয়োগ, শিল্প-বাণিজ্য, প্রযুক্তি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ, সব কিছুই আজ ইহুদীদের দখলে। মাত্র ০.২% বিশ্ব জনসংখ্যা নিয়ে কীভাবে তারা বিশ্ব অর্থনীতিতে এই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন? আজ আমরা খুঁজে দেখবো ইতিহাসের ভিতর—কীভাবে, কখন এবং কেন এমনটা হলো!
মধ্যযুগে ইহুদিদের অর্থনৈতিক ভূমিকা
সুদ ব্যবসা ও ব্যাংকিংয়ের সূচনা
মধ্যযুগে ইউরোপে খ্রিস্টানদের জন্য সুদে টাকা ধার দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল (Banned by Christian doctrine)। অন্যদিকে ইহুদি ধর্মে ব্যবসা ও সুদের ভিত্তিতে অর্থ ধার দেওয়া ছিল সামাজিকভাবে স্বীকৃত। ফলে সুদে ঋণ দেয়ার কাজ প্রায় একচেটিয়াভাবে ইহুদিদের হাতে চলে যায়।
শাসকদের অর্থজোগানদাতা হিসেবে ইহুদিরা
এ সময় ইহুদিরা ইউরোপের অনেক রাজা-রানীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হয়ে ওঠে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা যুদ্ধ, প্রাসাদ নির্মাণ ও বিভিন্ন খরচের জন্য ইহুদি ব্যাংকারদের কাছ থেকে ঋণ নিতে থাকেন।উদাহরণস্বরূপ, স্পেনের ক্যাথলিক রাজা ফার্ডিনান্ড ও ইসাবেলা আমেরিকা আবিষ্কারের জন্য ক্রিস্টোফার কলাম্বাসের ভ্রমণে অর্থায়ন করেছিলেন ইহুদি ব্যাংকার লুইস ডি স্যান্টাঞ্জেল-এর সহায়তায়। এছাড়াও ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি তার ব্যক্তিগত ঋণের জন্য ইহুদি ব্যবসায়ীদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন।
নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক অভিযোজন
১১শ থেকে ১৫শ শতাব্দীর মধ্যে ইহুদিরা একাধিকবার ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হন।উদাহরণস্বরূপ, ইংল্যান্ড (১২৯০), ফ্রান্স (১৩০৬), স্পেন (১৪৯২)। এইসময় তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে ছিল উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং পরে আমেরিকা।
এই বিতাড়নই অদ্ভুত ভাবে তাদের অর্থনৈতিক দক্ষতাকে বাড়িয়ে দেয়। তারা যেখানে যেখানে আশ্রয় পায়, সেখানেই ব্যাংকিং ও ঋণ বাণিজ্যে শুরু করে।এভাবেই ধীরে ধীরে তারা অর্থনৈতিক খাতে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে।এই সময় ইহুদিরা বিশ্বাস করত, “অর্থ আসবে, যাবে — কিন্তু সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ করতে পারলেই প্রভাব বাড়তে থাকবে।”
রেনেসাঁ ও শিল্প বিপ্লবে ইহুদিদের প্রভাব
১৬শ থেকে ১৮শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের আর্থিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়।এইসময় ইহুদি ব্যাংকার পরিবারগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাজনৈতিক বৈরিতা এবং ধর্মীয় বৈষম্যের মুখেও এই পরিবারগুলো তাদের দক্ষতা, দূরদর্শিতা ও নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইউরোপের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে।
রথসচাইল্ড পরিবার
ইহুদি ব্যাংকিং ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত নাম রথসচাইল্ড পরিবার। মায়ের আম্শেল রথসচাইল্ড ১৮শ শতকের শেষ দিকে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে ব্যাংকিং ব্যবসা শুরু করেন। তিনি নিজের পাঁচ ছেলেকে ইউরোপের পাঁচটি শহরে পাঠিয়ে একটি সুসংগঠিত ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। নাথান রথসচাইল্ড লন্ডনে প্রভাব বিস্তার করেন। ১৮১৫ সালের ওয়াটারলু যুদ্ধে ব্রিটেনের সরকারকে ঋণ দিয়ে এবং কৌশলী বিনিয়োগ করে নাথান বিপুল টাকা লাভ করে। এর ফলে রথসচাইল্ড পরিবার ইউরোপের অন্যতম ধনী ও প্রভাবশালী পরিবারে পরিণত হয়।
অন্যান্য প্রভাবশালী পরিবার
রথসচাইল্ডদের পাশাপাশি আরও কয়েকটি ইহুদি পরিবার ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে:
- রকফেলার পরিবার: রকফেলাররা তেল শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। ১৯শ শতকের শেষভাগে জন ডি. রকফেলার স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে।এই সময় তারা তেলের জগতে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে। এরফলে পরবর্তীতে অর্থনীতি ও রাজনীতিতেও তাদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
- মরগান পরিবার: আমেরিকান ব্যাংকিং এবং রেলওয়ে খাতের অন্যতম প্রধান শক্তি ছিল মরগান পরিবার। ২০শ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকার অর্থনৈতিক সংকটের সময় জে.পি. মরগান (J.P. Morgan) সরকারকে সহায়তা করেছিলেন।
শিল্প বিপ্লবে ইহুদি পুঁজিপতিদের ভূমিকা
ইউরোপ ও আমেরিকার শিল্প বিপ্লবের আর্থিক চালিকাশক্তি ছিলেন ইহুদি পুঁজিপতিরা। বিশেষ করে রথসচাইল্ড, ওয়ারবার্গ, ল্যাজার্ড, শিফ ও লেম্যান পরিবারের বিনিয়োগ ছিল শিল্প বিপ্লবের মেরুদণ্ড।
রেলওয়ে:
নাথান রথসচাইল্ড ১৮৩০ সালে ব্রিটেনে Liverpool and Manchester Railway-এ প্রথম বড় বিনিয়োগ করেন। আমেরিকায় জ্যাকব শিফ Northern Pacific Railway-এ ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে।
জাহাজ শিল্প:
১৯শ শতকের মাঝামাঝি, ওয়ারবার্গ ও ল্যাজার্ড পরিবার বাষ্পচালিত জাহাজ নির্মাণ প্রকল্পে বিনিয়োগ করেন। ল্যাজার্ড ব্রাদার্স কোম্পানি Transatlantic shipping routes-এ অর্থায়ন করে যা ইউরোপ-আমেরিকা বাণিজ্য সহজ করে তোলে।
তেল ও শক্তি খাত:
১৮৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে Standard Oil কোম্পানি গঠনের পেছনে ইহুদি ব্যাংকারদের বিনিয়োগ ছিল। এ ছাড়া রথসচাইল্ডরা ১৮৮৬ সালে Baku Oil Fields (আজারবাইজান) এ বিশাল বিনিয়োগ করে। পরবর্তিতে এটি বিশ্বের অন্যতম বড় তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে।
বর্তমান বিশ্বে ইহুদি প্রভাব
ক্ষেত্র | নাম | অবদান |
প্রযুক্তি | মার্ক জুকারবার্গ | ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা |
বিনিয়োগ | জর্জ সোরোস | বিশ্বব্যাপী হেজ ফান্ড |
মিডিয়া | বব আইগার | ডিজনির সিইও |
রাজনীতি | মাইকেল ব্লুমবার্গ | নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র, মিডিয়া টাইকুন |
বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
ইহুদিদের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে ইতিহাসজুড়ে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে আছে। সবচেয়ে পরিচিত হলো The Protocols of the Elders of Zion। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত এই দলিলে দাবি করা হয় ইহুদি নেতারা বিশ্ব দখলের পরিকল্পনা করছেন। একইভাবে “New World Order” তত্ত্বে বলা হয়, একটি গোপন ইহুদি গোষ্ঠী বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
উপসংহার
রথসচাইল্ডদের অদৃশ্য হাত থেকে ফেডারেল রিজার্ভের গুপ্ত ইতিহাস, প্রোটোকলসের কাল্পনিক ষড়যন্ত্র থেকে হলিউডের ছায়ায় প্রভাব বিস্তার—প্রতিটি স্তরে লুকিয়ে আছে অসংখ্য প্রশ্ন। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, কীভাবে একটি সম্প্রদায়, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বের অর্থনৈতিক হৃদয়কে নিয়ন্ত্রণ করছে?
তথ্যসূত্র
- https://www.britannica.com/topic/Jewish-Diaspora
- https://www.oxfordbibliographies.com/display/document/obo-9780199840731/obo-9780199840731-0106.xml
- https://www.cambridge.org/core/books/abs/cambridge-history-of-judaism/jews-and-the-early-modern-economy/1AEDBD2D6B5BDC94AB3100DB8187938B
- https://www.bu.edu/econ/files/2012/11/dp124.pdf
- https://www.pbs.org/newshour/economy/the-chosen-few-a-new-explanation-of-jewish-success
- https://www.adl.org/resources/backgrounder/jewish-control-federal-reserve-classic-antisemitic-myth