Image default
ইতিহাস ১০১

চুল কাটার প্রচলন : প্রাচীন মিশর থেকে আধুনিক সেলুনের গল্প

চুল কাটলে কখনো কখনো মানসিক শান্তি মেলে

মানুষ কেন চুল কাটে? এই প্রশ্নটি শুনতে সাধারণ মনে হলেও এর উত্তর লুকিয়ে আছে হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে, যা আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস আর ফ্যাশনের বিবর্তনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চুল কাটা শুধু একটি শারীরিক প্রয়োজন নয়, এটি এক গভীর সামাজিক, ধর্মীয় এবং শৈল্পিক এমনকি মানসিক  অভিব্যক্তি। 

কখনো শুনেছেন চুল কাটলে মনে শান্তি লাগে? হ্যাঁ, কখনো কখনো চুল কেটেও মনে শান্তি আনা যায়। প্রাচীন মিশরের ফারাওদের কামানো মাথা থেকে শুরু করে আধুনিক সেলুনের ট্রেন্ডি হেয়ারস্টাইল পর্যন্ত, এই যাত্রাপথটি মানব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

চুল কাটার সুদূর অতীত: প্রয়োজন থেকে প্রতীকবাদ

মানুষ কখন প্রথম চুল কাটা শুরু করেছিল তার সঠিক উত্তর হয়তো পাওয়া সম্ভব নয়। তবে  প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলেন, সেই পাথরের যুগেই সূচনা হয়েছিল চুল কাটার। ভাবুন তো, আদিম মানুষেরা ধারালো পাথর, হাড় বা ঝিনুকের ধারালো অংশ ব্যবহার করে নিজেদের চুল কাটত। এসব প্রাচীন পদ্ধতিতে তাদের হেয়ার কাট, স্টাইলই বা কেমন ছিলো। আর কেনোই বা তারা চুল কাটা শুরু করেছিল। 

প্রাথমিকভাবে, এর কারণ ছিল সম্ভবত খুবই সাধারণ। লম্বা চুল শিকার বা দৈনন্দিন কাজে বাধা দিত, অথবা পরজীবীর উপদ্রব থেকে মুক্তি পেতে চুল ছোট রাখা হতো। কিন্তু খুব দ্রুতই এটি নিছক প্রয়োজনের গণ্ডি পেরিয়ে সামাজিক এবং ধর্মীয় তাৎপর্য লাভ করে। চুল হয়ে ওঠে ক্ষমতা, মর্যাদা, পবিত্রতা বা এমনকি বিদ্রোহের প্রতীক। আর বর্তমান সময়ের ফ্যাশনের কথা তো আর আলাদা করে বলতেই হয় না।

প্রাচীন সভ্যতায় চুলের ভাষা: মিশরের পবিত্রতা থেকে রোমান সাম্রাজ্যের আভিজাত্য

বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতায় চুলের নিজস্ব ভাষা ছিল। মেসোপটেমীয়রা লম্বা দাড়ি রাখত, যা ছিল তাদের প্রজ্ঞা আর ক্ষমতার প্রতীক। তবে চুল প্রায়শই ছোট করে ছাঁটা হতো বা বিনুনি করা হতো। নারীরা তাদের চুলকে নানা রূপে সাজাতো, যা তাদের সামাজিক অবস্থান বোঝাতে সাহায্য করতো।

প্রাচীন মিশরে চুল কাটার রীতি ছিল সবচেয়ে স্বতন্ত্র। মিশরীয়রা পরিচ্ছন্নতাকে এতটাই গুরুত্ব দিত যে, পুরুষ ও মহিলা উভয়ই মাথা সম্পূর্ণ কামিয়ে ফেলত। তাদের বিশ্বাস ছিল, লম্বা চুল পরজীবী বহন করে এবং পবিত্রতাকে ব্যাহত করে। তাই তারা এর পরিবর্তে উইগ ব্যবহার করত। এই উইগগুলো প্রাকৃতিক চুল বা উদ্ভিজ্জ ফাইবার দিয়ে তৈরি হতো এবং ফারাও বা অভিজাতদের উইগগুলো বিশেষভাবে অলংকৃত ও জটিল হতো, যা তাদের মর্যাদা ও ঐশ্বর্য প্রকাশ করত। এমনকি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে পুরোহিতরা পবিত্রতার জন্য শরীরের সমস্ত চুল কামিয়ে ফেলতেন। এটি ছিল এক ধরনের আত্মশুদ্ধি প্রক্রিয়া।

রোমান সাম্রাজ্যে চুলের স্টাইল ছিল আভিজাত্য আর পরিচয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রথমদিকে পুরুষরা ছোট চুল রাখত এবং দাড়ি কামাতো, যা ছিল মূলত গ্রীক সংস্কৃতির প্রভাব। সম্রাট অগাস্টাসের আমল থেকে মসৃণ, ছোট চুল আর দাড়ি-গোঁফ কামানো মুখ ছিল একজন রোমান ভদ্রলোকের আদর্শ চেহারা। নারীদের চুলের স্টাইল ছিল আরও বিস্তারিত। উচ্চবিত্ত নারীরা তাদের চুল বিভিন্ন বিনুনি, উঁচু করে বাঁধা বান এবং অলংকৃত হেয়ারপিন দিয়ে সাজাতো। এই কাজগুলো করত বিশেষ দাসরা, যাদের ‘টনসর’ (tonsor) বলা হতো।

মধ্যযুগের সরলতা ও ধর্মের প্রভাব: খ্রিস্টান ধর্ম থেকে ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম

মধ্যযুগের ইউরোপে চুল কাটার ধারা মূলত খ্রিস্টান ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বিনয় এবং সরলতাকে গুরুত্ব দেওয়ায় পুরুষদের চুল ছোট রাখা সাধারণ নিয়ম ছিল। সন্ন্যাসী ও পুরোহিতরা তাদের মাথার মাঝখানের অংশ কামিয়ে ফেলতেন, যা ‘টনসুর’ (tonsure) নামে পরিচিত এবং ঈশ্বরের প্রতি তাদের উৎসর্গের প্রতীক ছিল। নারীরা সাধারণত লম্বা চুল রাখত, তবে বিনয়ের প্রতীক হিসেবে ঘোমটা বা মাথা ঢাকা রাখত।

ইসলাম ধর্মে পুরুষদের জন্য দাড়ি রাখা সুন্নত এবং চুল ঘাড় পর্যন্ত ছোট রাখা বা নির্দিষ্ট স্টাইলে কাটা সুন্নত। তবে নারীদের চুল ছোট করার ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আছে; সাধারণত স্বামীর অনুমতি ছাড়া তারা চুল ছোট করেন না এবং জনসমক্ষে চুল প্রদর্শন না করার নির্দেশ রয়েছে। হজ ও উমরার সময় পুরুষদের চুল কামানো বা ছোট করা (হলক বা কাসর) একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অংশ।

হিন্দু ধর্মেও চুল কাটার নিজস্ব তাৎপর্য রয়েছে। শিশুদের প্রথম চুল কামানো (চূড়াকরণ বা মুণ্ডন) এক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার, যা শিশুর শুদ্ধতা এবং পূর্বজন্মের পাপ থেকে মুক্তি নির্দেশ করে। অনেক মন্দিরে ভক্তরা মানত পূরণের জন্য চুল উৎসর্গ করে। লম্বা চুলকে নারীত্বের প্রতীক মনে করা হয়, তবে কিছু সম্প্রদায়ে বিধবা নারীরা শোক ও বৈরাগ্যের প্রতীক হিসেবে চুল ছোট করতেন বা কামিয়ে ফেলতেন। এখন অবশ্য বিধবা নারীদের চুল কাটার রীতি বিলোপ হয়েছেন।

সামাজিক শ্রেণী বিভাজন: চুলই বলে দিত আপনার পরিচয়

চুল কাটা এবং চুলের স্টাইল বরাবরই সামাজিক শ্রেণী বিভাজনের এক শক্তিশালী প্রতীক ছিল। সমাজের উচ্চবিত্তরা প্রায়শই জটিল ও ব্যয়বহুল হেয়ারস্টাইল করত, যা তাদের সম্পদ ও ক্ষমতা প্রদর্শন করত। অন্যদিকে, সাধারণ মানুষ বা শ্রমিক শ্রেণীর মানুষেরা ব্যবহারিক কারণে ছোট ও সাধারণ হেয়ারস্টাইল রাখত। যেমন, সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপে, লম্বা, কোঁকড়ানো উইগ পরা ছিল অভিজাত পুরুষদের ফ্যাশন, যা তাদের সামাজিক অবস্থানকে স্পষ্ট করত। দাস ও নিম্নবিত্তদের চুল প্রায়শই অগোছালো বা কেটে ছোট রাখা হতো, যা তাদের সামাজিক অধীনতা নির্দেশ করত।

হেয়ারস্টাইল ও কাঁচির আগমন: ফ্যাশন ও প্রযুক্তির হাতছানি

আধুনিক অর্থে হেয়ারস্টাইলের ধারণার উদ্ভব হয় রেনেসাঁস যুগে, যখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং ফ্যাশনের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। বিশেষ করে ফরাসি রাজদরবারে চুলের স্টাইল এক শিল্প রূপে বিকশিত হয়। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে উইগ ও পাউডার করা চুলের ফ্যাশন তুঙ্গে ওঠে।

প্রথমবার কাঁচি দিয়ে চুল কাটা কবে শুরু হয়, তা নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। প্রাচীন মিশরীয় ও রোমান সভ্যতায় ব্রোঞ্জের তৈরি কাঁচির মতো যন্ত্রের ব্যবহার ছিল, তবে তা সম্ভবত বহুমুখী কাজে ব্যবহৃত হতো। আধুনিক কাঁচির ব্যবহার সম্ভবত মধ্যযুগের শেষদিকে বা রেনেসাঁস যুগে শুরু হয়, যখন ধাতুবিদ্যা উন্নত হয় এবং সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি তৈরি সম্ভব হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে, চুল কাটার জন্য বিশেষভাবে নকশা করা তীক্ষ্ণ কাঁচি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে, যা নাপিতদের কাজকে আরও সহজ ও নির্ভুল করে তোলে। এই কাঁচিই নাপিত পেশার বিপ্লব ঘটায়।

চুল কাটার আধুনিক ও পুরাতন যন্ত্রপাতি

নারীদের চুলের বিপ্লব: ছোট চুল ও মুক্তির ডাক

ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ধরে নারীদের জন্য লম্বা চুল ছিল নারীত্ব, সৌন্দর্য এবং সামাজিক অবস্থানের প্রতীক। চুল ছোট করা বা কাটা প্রায়শই অসম্মান, শোক বা বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, বিশেষ করে ১৯২০-এর দশকে ‘ফ্ল্যাপার’ (flapper) যুগে, নারীদের চুল ছোট করার প্রবণতা শুরু হয়। ‘বব’ (bob) কাট ছিল এই সময়ের এক বিপ্লবী হেয়ারস্টাইল, যা নারী মুক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে। এটি ছিল নারীদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক বিধিনিষেধ থেকে বেরিয়ে আসার এবং নিজেদের স্বাধীনতা প্রকাশের এক সাহসী পদক্ষেপ। এরপর থেকে, নারীদের হেয়ারস্টাইলে অগণিত বৈচিত্র্য এসেছে, যা তাদের আত্মপ্রকাশ ও ফ্যাশন সচেতনতার প্রতিফলন ঘটায়।

নারীদের বিভিন্ন হেয়ার স্টাইল

নাপিত ও সেলুনের জন্ম: এক পেশাদারী বিবর্তন

নাপিত (Barber) পেশার ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। প্রাচীনকাল থেকেই নাপিতরা শুধু চুল কাটত না, বরং ছোটখাটো অস্ত্রোপচার, দাঁত তোলা এবং রক্তমোচনের মতো কাজও করত। মধ্যযুগে নাপিতরা ‘নাপিত-সার্জন’ (barber-surgeons) নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে চিকিৎসা পেশা আলাদা হয়ে গেলে, নাপিতরা শুধু চুল কাটা, দাড়ি কামানো এবং চুলের স্টাইলিংয়ে মনোযোগ দেয়।

সেলুন (Salon) বা হেয়ারড্রেসিং পার্লারের ধারণা আধুনিক সমাজের একটি অংশ। ১৯শ শতাব্দীর শেষ এবং ২০শ শতাব্দীর শুরুর দিকে সেলুনগুলি পুরুষ ও মহিলাদের জন্য পৃথক স্থান হিসেবে গড়ে ওঠে। এগুলি শুধু চুল কাটার জায়গা ছিল না, বরং সামাজিক মিলনস্থলও ছিল। আধুনিক সেলুনগুলি কেবল চুল কাটা বা স্টাইলিং নয়, চুলের যত্ন, রঙ করা এবং অন্যান্য বিউটি সার্ভিসও সরবরাহ করে। বর্তমানে সেলুনগুলি ফ্যাশন ও ব্যক্তিগত যত্নের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে

হেয়ার ফ্যাশন ও হেয়ার কেয়ার: সৌন্দর্যের বিরামহীন যাত্রা

হেয়ার ফ্যাশন সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে, যা সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতিফলন। প্রতিটি যুগ তার নিজস্ব হেয়ারস্টাইল নিয়ে এসেছে, যা সেই সময়ের ফ্যাশন, শিল্প এবং জীবনযাত্রার ধরনকে প্রভাবিত করেছে। রেট্রো থেকে ভিনটেজ, পাঙ্ক থেকে গ্ল্যামারাস – হেয়ার ফ্যাশন ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে।

হেয়ার কেয়ারের ইতিহাসও কম বৈচিত্র্যময় নয়। প্রাচীনকালে মানুষ প্রাকৃতিক উপাদান যেমন উদ্ভিজ্জ তেল, ভেষজ এবং কাদা ব্যবহার করে চুল পরিষ্কার ও সুস্থ রাখত। রোমানরা শ্যাম্পুর পূর্বসূরি ব্যবহার করত, যা প্রাকৃতিক সাবান ও ছাই দিয়ে তৈরি হতো। আধুনিক শ্যাম্পু, কন্ডিশনার এবং চুলের যত্নের পণ্য ১৯শ শতাব্দীর শেষ ও ২০শ শতাব্দীর শুরুর দিকে জনপ্রিয়তা লাভ করে, যখন রাসায়নিক ও উৎপাদন প্রযুক্তির উন্নতি হয়। বর্তমানে, চুলের যত্নের শিল্প এক বিশাল বৈশ্বিক বাজার, যা চুলের স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন উদ্ভাবনী পণ্য ও পরিষেবা সরবরাহ করে।

আধুনিক সেলুন

চুল কাটা, এক নিরন্তর পরিবর্তনশীল গল্প

কেন মানুষ চুল কাটে? এর উত্তর একরৈখিক নয়। এটি প্রয়ো  জন, ধর্ম, সংস্কৃতি, সামাজিক মর্যাদা, ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি এবং ফ্যাশনের এক জটিল বুনন। আদিম গুহা থেকে শুরু করে ঝলমলে আধুনিক সেলুন পর্যন্ত, চুল কাটার এই যাত্রা মানব সভ্যতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা প্রতিনিয়ত বিকশিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতের ফ্যাশন ও পরিচয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। চুল কাটা শুধু একটি কাজ নয়, এটি মানুষের আত্মপ্রকাশের এক চিরন্তন গল্প।

 তথ্যসূত্র

Related posts

হিপ্পি আন্দোলন

সহী হাবীব

এপ্রিল ফুল: নিছক মজা নাকি সাজা?

পরীক্ষার জন্ম: যেভাবে হাজার বছরের এক চীনা উদ্ভাবন শাসন করছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More