Image default
যাপন

ভালো থাকা মানে কি শুধু সুখ? মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা যা বলছে

আপনি কি সুখী নাকি সত্যিই ভালো আছেন? নিশ্চয়ই ভাবছেন, এই দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য কী? আধুনিক গবেষণা বলছে, শুধু সুখের পেছনে ছোটা এক মরীচিকা মাত্র; সত্যিকারের ভালো থাকার রহস্য লুকিয়ে আছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুতে।

ভালো আছেন তো?

“কেমন আছেন?” এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা প্রায়শই বলি, “ভালো আছি”। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, এই ‘ভালো থাকা’ বলতে আমরা ঠিক কী বোঝাই? বেশিরভাগ মানুষের কাছে ভালো থাকা মানেই হলো সুখী, দুশ্চিন্তামুক্ত, হাসিখুশি একটি জীবন। আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, এমনকি বিজ্ঞাপন জগৎ; সবাই যেন আমাদের শেখায় যে, সুখ অর্জনই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। সুখী হতে পারলেই যেন জীবনের সব পাওয়া হয়ে গেল।

কিন্তু আধুনিক মনোবিজ্ঞান এবং প্রাচীন দর্শন বলছে ভিন্ন কথা। তাদের মতে, ভালো থাকা (Well-being) এবং সুখে থাকা (Happiness) এই দুটি বিষয় এক নয়। সুখ ভালো থাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে, কিন্তু এটিই সব নয়। ভালো থাকা হলো একটি গভীর, ব্যাপক এবং স্থিতিশীল অবস্থা, যা ক্ষণস্থায়ী আনন্দের অনুভূতির চেয়ে অনেক বেশি জরুরি এবং অর্থবহ।

তাহলে সুখ এবং ভালো থাকার মধ্যে আসল পার্থক্যটা কোথায়? কীভাবে আমরা ক্ষণস্থায়ী সুখের পেছনে না ছুটে সত্যিকারের, অর্থপূর্ণ ভালো থাকা অর্জন করতে পারি? 

হাসিখুশি মানুষ

সুখের গোলকধাঁধা: হেডোনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জগৎ

যখন আমরা ‘সুখ’ বা ‘হ্যাপিনেস’ শব্দটি ব্যবহার করি, তখন আমরা সাধারণত এক ধরনের ইতিবাচক অনুভূতির কথা বলি। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় হেডোনিক ওয়েলবিয়িং (Hedonic Well-being)। এই ধারণাটির মূল প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘হেডোন’ (hedone) থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘আনন্দ’ বা ‘তৃপ্তি’।

হেডোনিক সুখ হলো সেই অনুভূতি, যা আমরা কোনো আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা থেকে লাভ করি। যেমন:

  • প্রিয় খাবার খাওয়ার মুহূর্তের আনন্দ।
  • একটি মজার সিনেমা দেখার পর ভালো লাগা।
  • বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার উচ্ছ্বাস।
  • বেড়াতে গিয়ে নতুন জায়গা দেখার উত্তেজনা।
  • কর্মক্ষেত্রে প্রশংসা পাওয়ার তৃপ্তি।

এই ধরনের সুখ আমাদের জীবনের জন্য অবশ্যই প্রয়োজনীয়। এটি আমাদের মনকে সতেজ করে, মানসিক শক্তি জোগায় এবং জীবনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করে। কিন্তু এর একটি বড় সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। হেডোনিক সুখ মূলত ক্ষণস্থায়ী যা বিভিন্ন পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। যে কারণটির জন্য সুখ তৈরি হয়েছিল, সেই কারণটি চলে গেলে সুখের অনুভূতিও মিলিয়ে যায়।

বিষন্ন মনে একজন মানুষ বসে আছে

এখানেই মনোবিজ্ঞানীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণার কথা বলেন, যার নাম ‘হেডোনিক ট্রেডমিল’ (Hedonic Treadmill)। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষ খুব দ্রুত যেকোনো ভালো বা খারাপ পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। 

ধরুন, আপনি লটারিতে অনেক টাকা জিতলেন। প্রথম কয়েক সপ্তাহ বা মাস হয়তো আপনার আনন্দের সীমা থাকবে না। কিন্তু ধীরে ধীরে আপনি এই নতুন অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন এবং আপনার সুখের মাত্রা আবার আগের জায়গায় ফিরে আসবে। একইভাবে, একটি নতুন ফোন কেনা বা চাকরিতে পদোন্নতি পাওয়ার আনন্দও কিছুদিন পরেই ফিকে হয়ে যায়। আমরা আবার নতুন কোনো সুখের উৎসের পেছনে ছুটতে শুরু করি। এই অবিরাম ছুটে চলাই হলো হেডোনিক ট্রেডমিল, যা আমাদের সুখী হওয়ার অনুভূতি দেয়, কিন্তু সত্যিকারের এবং স্থায়ী ‘ভালো থাকা’ দিতে পারে না।

ভালো থাকার গভীর অর্থ: ইউদাইমোনিয়ার পথে যাত্রা

হেডোনিক সুখের বিপরীতে, মনোবিজ্ঞানীরা ভালো থাকার আরেকটি গভীর এবং অর্থপূর্ণ ধারণার কথা বলেন, যার নাম ইউদাইমোনিক ওয়েলবিয়িং (Eudaimonic Well-being)। এই ধারণাটির প্রবক্তা ছিলেন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল। ‘ইউদাইমোনিয়া’ (Eudaimonia) শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দের সমন্বয়ে গঠিত: ‘ইউ’ (eu), যার অর্থ ‘ভালো’, এবং ‘দাইমন’ (daimon), যার অর্থ ‘আত্মা’ বা ‘ ভেতরের সত্তা’। সুতরাং, ইউদাইমোনিয়া মানে হলো নিজের ভেতরের সত্তাকে বিকশিত করা, নিজের সর্বোচ্চ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে একটি অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করা।

ইউদাইমোনিয়া মানে সবসময় হাসিখুশি থাকা নয়। এটি হলো জীবনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, নিয়ে আনন্দের সাথে বেঁচে থাকা। 

গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল

ইউদাইমোনিক ভালো থাকার কয়েকটি উদাহরণ:

  • কঠিন পরিশ্রম করে একটি নতুন দক্ষতা অর্জন করা (যেমন—একটি ভাষা শেখা বা বাদ্যযন্ত্র বাজানো)।
  • সন্তান লালন-পালনের মতো একটি কষ্টকর কিন্তু অর্থপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা।
  • সামাজিক বা মানবিক কোনো কাজের সাথে যুক্ত হয়ে অন্যের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা।
  • নিজের নৈতিক মূল্যবোধ অনুযায়ী জীবনযাপন করা, এমনকি যদি তা কঠিনও হয়।
  • ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবনে কোনো বড় সংকট মোকাবেলা করে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠা।

এই কাজগুলো করার মুহূর্তে হয়তো সবসময় আনন্দ বা সুখ অনুভূত হয় না। এর মধ্যে হয়তো থাকে ক্লান্তি, ব্যর্থতা, এবং কখনও কখনও বেদনাও। কিন্তু এই কাজগুলো আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে, যার ফলে কেবল সাময়িক সুখের পেছনে না ছুটে মানুষ দীর্ঘস্থায়ী সন্তুষ্টির জন্য ভালো থাকার চেষ্টা করে।  

 এখানেই সুখ এবং ভালো থাকার মূল পার্থক্য। সুখ হলো একটি অনুভূতি, যা আমরা বিশেষ কিছু মুহূর্তে পাই পাই। অন্যদিকে, ভালো থাকা হলো একটি জীবনযাপনের পদ্ধতি, যা আমরা বিভিন্ন উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে অর্জন করি।

আধুনিক বিজ্ঞানের চোখে ‘ভালো থাকা’: PERMA মডেল

প্রাচীন গ্রিকদের এই দার্শনিক ধারণাকেই আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ‘পজিটিভ সাইকোলজি’ বা ইতিবাচক মনোবিজ্ঞানের অন্যতম পুরোধা, মার্টিন সেলিগম্যান, ভালো থাকার একটি বৈজ্ঞানিক মডেল তৈরি করেছেন, যা PERMA মডেল নামে পরিচিত। তার মতে, সত্যিকারের ভালো থাকা এই পাঁচটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে:

১. P – Positive Emotion (ইতিবাচক অনুভূতি): এটি হলো ভালো থাকার হেডোনিক অংশ—আনন্দ, ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা এবং আশার মতো ইতিবাচক অনুভূতিগুলো অনুভব করা।

২. E – Engagement (সম্পৃক্ততা): এটি হলো কোনো কাজে এতটাই গভীরভাবে ডুবে যাওয়া যে, সময়, স্থান এবং নিজের সম্পর্কে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা। একে ‘ফ্লো’ (Flow) অবস্থাও বলা হয়। এটি হতে পারে কোনো শখের কাজ, লেখালেখি, খেলাধুলা বা যেকোনো সৃজনশীল কাজ।

৩. R – Relationships (সম্পর্ক): মানুষের সাথে অর্থপূর্ণ এবং ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখা ভালো থাকার অন্যতম প্রধান উপাদান। পরিবার, বন্ধু এবং সামাজিক পরিমণ্ডলে ভালোবাসা, সহযোগিতা এবং সহানুভূতির সম্পর্ক আমাদের মানসিক শক্তি জোগায়।

৪. M – Meaning (অর্থ): নিজের জীবনের চেয়েও বড় কোনো কিছুর সাথে যুক্ত থাকা। এটি হতে পারে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, সামাজিক সেবা, বা এমন কোনো কাজ, যা নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে অন্যের বা সমাজের জন্য করা হয়।

৫. A – Accomplishment (কৃতিত্ব): কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করা এবং তা অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা করা। সাফল্য বা কৃতিত্ব অর্জন আমাদের মধ্যে যোগ্যতা এবং আত্মবিশ্বাসের অনুভূতি তৈরি করে।

সেলিগম্যানের এই মডেলটি স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে, ‘ভালো থাকা’ শুধু ইতিবাচক অনুভূতি বা সুখের (P) উপর নির্ভরশীল নয়। এটি একটি সামগ্রিক প্যাকেজ, যেখানে সম্পৃক্ততা, সম্পর্ক, অর্থ এবং কৃতিত্ব—প্রত্যেকটিরই সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

PERMA মডেল

 সন্তুষ্টি: ভালো থাকার আয়না

ভালো থাকার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হলো সন্তুষ্টি (Satisfaction)। এটি কোনো ক্ষণস্থায়ী অনুভূতি নয়, বরং এটি হলো নিজের জীবনকে সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করার একটি প্রক্রিয়া। আপনি যখন আপনার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে মনে করেন যে, “হ্যাঁ, আমার জীবনটা ঠিক পথেই এগোচ্ছে এবং আমি যা করছি তা অর্থপূর্ণ”, তখন সেই অনুভূতিটিই হলো সন্তুষ্টি।

একজন ব্যক্তি হয়তো প্রতিদিন পার্টি করে বা মজার ভিডিও দেখে হেডোনিক সুখে থাকতে পারেন, কিন্তু তার জীবনে যদি কোনো উদ্দেশ্য বা গভীর সম্পর্ক না থাকে, তবে তার জীবনে সন্তুষ্টির অনুভূতি ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করে।

 অন্যদিকে, একজন সমাজকর্মী হয়তো প্রতিদিন অনেক কষ্ট এবং সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যান, যা তাকে তাৎক্ষণিক আনন্দ দেয় না। কিন্তু দিনের শেষে, তিনি যখন ভাবেন যে তার কাজের মাধ্যমে তিনি অন্যের জীবনে পরিবর্তন আনছেন, তখন তিনি এক গভীর সন্তুষ্টি লাভ করেন। এই সন্তুষ্টির অনুভূতিই হলো ইউদাইমোনিক ভালো থাকার প্রতিচ্ছবি।

তাহলে, ভালো থাকা মানে কি শুধু সুখ? গবেষণা এবং দর্শন; উভয়ই বলছে, না।  শুধু সুখের পেছনে ছোটা আমাদেরকে হেডোনিক ট্রেডমিলে আটকে ফেলতে পারে, যেখানে আমরা এক আনন্দ থেকে আরেক আনন্দের পেছনে ছুটতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ি, কিন্তু সত্যিকারের সন্তুষ্টি পাই না।

এর পরিবর্তে, মনোবিজ্ঞানীরা আমাদের একটি অর্থপূর্ণ জীবন গড়ার দিকে মনোযোগ দিতে বলেন। যখন আমরা সাময়িক সুখের প্রতি নজর না দিয়ে ভালো থাকার উপর জোর দিই, তখন কেবল সুখী হওয়াই আর আমাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে না; এটি হয়ে ওঠে এই সুন্দর এবং অর্থপূর্ণ জীবনযাপনের প্রধান কারণ। 

তথ্যসূত্র –

Related posts

ত্বকের ধরণ অনুযায়ী কোন রঙের পোশাক সবচেয়ে ভালো ?

সময় কম? দেখে নিন আপনার জন্য উপযুক্ত ব্যায়াম

ইম্পোস্টার সিনড্রোম কীভাবে সফলতার পথে বাধা সৃষ্টি করে?

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More