Image default
নগর পরিচিতি

কায়রো – প্রাচীন কোলাহলের শহর

“কায়রোতে ট্রাফিক আটকে আছে, আমরা এগোচ্ছি না, কিন্তু আমরা একসঙ্গে আটকে আছি!”

বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক শহর গুলোর কথা উঠলেই মিশরের রাজধানী কায়রোর নাম আসে। পৃথিবীর দীর্ঘতম নীলনদের তীরে অবস্থিত এই শহর যেন প্রাচীন সভ্যতা এবং আধুনিক জীবনযাত্রা এক অসাধারণ সংমিশ্রণ। এই শহর শুধু মিশরেরই নয়, বরং, পুরো আরব বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও জনবহুল শহর। 

দেশ মিশর
অঞ্চল/ রাজ্য কায়রো গভর্নরেট
আয়তন আনুমানিক ৩০৮৫ বগকিলোমিটার 
জনসংখ্যা এক কোটি দুই লক্ষ 
সরকারি ভাষা  আরবি
প্রধান মুদ্রা মিশরীয় পাউন্ড “গিনে” 
সময় অঞ্চল UTC+2
আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর কায়রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ( CIA) 

ভৌগলিক অবস্থান ও জলবায়ু 

কায়রো মিশরের উত্তর অংশে অবস্থিত, যা নিম্ন মিশর নামে পরিচিত। আফ্রিকার অন্যতম প্রধান নদী নীলনদের তীরে অবস্থিত কায়রো। শহরটির উত্তরে ১৬৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ভূমধ্যসাগর। পূর্বে রয়েছে সুয়েজ উপসাগর ও সুয়েজ খাল, সিনাই উপদ্বীপ এবং লোহিত সাগর। আর এর পশ্চিমে রয়েছে সাহারা মরুভূমি। 

কায়রোতে উষ্ণ মরুভূমি জলবায়ু (Hot Desert Climate) বিরাজমান, যা “Köppen climate classification” অনুযায়ী BWh হিসেবে পরিচিত। এর মানে বছরের বেশিরভাগ সময় কায়রোতে শুষ্ক এবং রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া থাকে।

ম্যাপ 

কায়রোর আয়তন ও জনসংখ্যা

কায়রো বিশ্বে অন্যতম জনবহুল শহর হিসেবে পরিচিত। কায়রোর আয়তন ৩,০৮৫ বর্গকিলোমিটার এবং এখানে বসবাস করে প্রায় দুই কোটির বেশি মানুষ। পুরো আরব বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র কায়রো জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির ফলে বাসস্থান ও পরিবহনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।  

শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মুসলমান ছাড়াও, শহরটিতে ৫-১০% খ্রিস্টান রয়েছে যার বড় অংশ কপ্টিক অর্থোডক্স খ্রিস্টান। এই শহরের সেন্ট মার্ক ক্যাথিড্রালেই কপ্টিক অর্থোডক্স পোপ বসবাস করেন।

কায়রোর জনসংখ্যা

কায়রোর ইতিহাস

যদিও প্রথমে লেখা হয়েছে যে, প্রাচীন শহর বলতে কায়রোর নাম আসে, মিশরের বিবেচনায়, কায়রো কিন্তু তুলনামূলকভাবে আধুনিক শহর। মিশরীয় সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ এরও বেশি বছর পুরনো, অর্থাৎ আজ থেকে ৫ হাজার বছরের বেশি আগের। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ফাতিমী যুগে ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে কায়রোর পত্তন হয়। তাই, প্রাচীন মিশরীয়, পারস্য ও রোমান সভ্যতার দিনগুলো কায়রো পায়নি। তবে গিজার স্মৃতিচিহ্নসমূহ ও প্রাচীন মেম্ফিস, হেলিওপোলিস আর রোমান ব্যাবিলন দুর্গ কায়রোকে অতীত যুগগুলোর সাথে সংযুক্ত করে।

কায়রোর নামকরণ 

কায়রো নামকরণের পিছনে একটি মজার গল্প রয়েছে। কায়রো শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ “আল-কাহিরা” থেকে যার অর্থ “বিজয়ী” বা “জয়ী শহর”। বলা হয়ে যে, শহরটি প্রতিষ্ঠার সময় আকাশে মঙ্গল গ্রহ দেখা যাচ্ছিল। এই মঙ্গল গ্রহের আরবি শব্দ “আল-ক্বাহির”, আর এই শব্দ থেকেই কায়রো শব্দের উৎপত্তি।

সংস্কৃতি ও জীবনধারা

বিশ্বের অন্যতম পুরনো সংস্কৃতি ও ইতিহাসে সমৃদ্ধ নগরকেন্দ্র হলো কায়রো। নীলনদের সাথে কায়রো গভীরভাবে জড়িত। বলা হয়ে থাকে কায়রো শহরের ইতিহাস এক হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। ফাতিমী শাসক আল-মুয়িজ লি-দিন আল্লাহ ৯৬১ খ্রিস্টাব্দে কায়রো প্রতিষ্ঠা করেন। 

কায়রো ও নীলনদ

কায়রোর বসতিস্থাপনের ইতিহাস অনেক পুরনো। কেননা, এটি একটি নদীর তীরে অবস্থিত। প্রাচীনকালে নদীর তীরেই বিভিন্ন সভ্যতা গড়ে উঠতো। নদীর তীরবর্তী এলাকায় উর্বর মাটি ও বসতি স্থাপনের প্রয়োজনীয় উপকরণ পাওয়া যেত। এই নদী শুধু প্রাকৃতিক সম্পদই ছিল না বরং এটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল সভ্যতা এবং তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি।

নীল নদের উপর প্রাচীন মিশরীয়রা এমনই নির্ভরশীল ছিল যে তারা এমনকি নীল নদের বন্যার উপর ভিত্তি করে তাদের ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিল। বন্যা, বীজ বোপন এবং ফসল তোলা ছিল মিশরের তিনটি মৌসুম। এই জন্য নীলনদকে বলা হয় “মিশরের জীবনরেখা”। এই নীলনদ প্রাচীনে যেমন মিশরীয়দের খাদ্য উৎপাদন ও সামরিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে আজ এটি ব্যবহৃত হচ্ছে  মিশরের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পানি সঞ্চালনের অন্যতম উৎস হিসেবে ।

গাড়ির অস্বাভাবিক চাপ

কায়রোর সামাজিক জীবন বেশ পরিবারমুখী এবং এখানে ইসলাম ধর্মের গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এখানে অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে সড়কের যানজট, কর্মস্থলে চাপ ও জীবিকা সম্পন্ন ব্যস্ততা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। মিশরের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগই বসবাস করে এই শহরে। এই জনসংখ্যার পাশাপাশি শহরটিতে গাড়ির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কায়রোতে মোটামুটি সাড়ে চার লক্ষ গাড়ি রয়েছে। গাড়ির এই সংখ্যার কারণে কায়রোর রাস্তায় থাকা গাড়িগুলোর চাকা খুব কমই ঘুরতে দেখা যায়। এই নিয়ে একটা মজাদার কথাও প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে, 

“কায়রোতে ট্রাফিক আটকে আছে, আমরা এগোচ্ছি না, কিন্তু আমরা একসঙ্গে আটকে আছি!”

কোলাহলের শহর কায়রো

কায়রো শহর বেশ কোলাহলপূর্ণ। এখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে দেখা যায় নানান রঙ। শহরটি তার কোলাহলপূর্ণ রাস্তা, দ্রুতগামী ট্যাক্সি, পথচলতি হকার, এবং চা দোকানে জমে ওঠা আলাপচারিতার জন্য বিখ্যাত। কায়রোর প্রতিটি রাস্তায় হাঁটলে মনে হয়, এখানে যেন সময় থেমে নেই। কায়রোর এই কোলাহল নিয়ে বিখ্যাত উপন্যাসিক সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন,

“কায়রোর রাস্তায় যেন এক বহতা নদী—মানুষের স্রোত অবিরত বইছে, থামার নাম নেই। একবার ভিড়ে ঢুকে পড়লে নিজেকে নৌকোর মাঝি মনে হয়, যার দাঁড় বাইতে বাইতে গন্তব্যের আগেই হাত ধরে লেগে যায়।”

নাইলে ভাসমান কায়রোবাসীর অবসর

কায়রোর মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নীলনদ দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত। সন্ধ্যা নামলেই নীলনদের তীরে ভিড় জমায় শহরের স্থানীয় বাসিন্দারা। কেউ জাহাজে ভাসমান ক্যাফেতে বসে মিশরীয় কফি পান করছে, আবার কেউ পরিবার নিয়ে নৌকায় চড়ে শহরের বাতাস উপভোগ করছে। নীলনদের ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখা যেন কায়রোবাসীর একটি নিত্যদিনের উৎসব।

কায়রোর রাতের সৌন্দর্য্য

তবে সবকিছু ঊর্ধ্বে, রাতের বেলা কায়রোর জমজমাট পরিবেশ সবারই আকর্ষণ কাড়ে। রাতের কায়রোর অভিজ্ঞতা খুব রোমাঞ্চকর। এই সময় বেশ কিছু উপভোগ করার মতো কার্যক্রম রয়েছে। যেওমন- নীল নদে পেলিকা (ঐতিহ্যবাহী পাল তোলা নৌকা) চড়ে কায়রোর রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়, আবার আধুনিক ডিনার ক্রুসে লাইভ মিউজিকে বেলি ডান্স দেখার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও এখানে নীলনদের তীরে বেশ কিছু ক্যাফে রয়েছে যা রাতের আলোয় এবং মানুষের জমজমাট আড্ডার কেন্দ্রে পরিণত হয়।

আরেকটি বড় আকর্ষণ হল, গিজার পিরামিড এলাকায় রাতে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো- দেখানো হয়, যা দেখতে পারা লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স বলা যায়। রাতের আলোয় যখন মসজিদ এবং প্রাচীন স্থাপনা গুলো ঝলমল করে তা পুরো শহরকে যেন এক জাদুকরি রূপে সাজিয়ে দেয়।

যোগাযোগ ব্যবস্থা

কায়রোর মেট্রো ব্যবস্থা আফ্রিকা এবং আরব বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র সম্পূর্ণ কার্যকর মেট্রো সিস্টেম। তবে শহরটির যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি মজার বিষয় হলো টুকটুক। কায়রোজুড়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং সংকীর্ণ এলাকায় টুকটুক নামের যানবাহনের ব্যবহার দেখা যায়। টুকটুক হলো টেম্পো জাতীয় তিন চাকার গাড়ি। 

টুকটুক

কায়রোর পর্যটন স্থান

কায়রো অত্যাশ্চর্য এবং প্রাচীন রাজধানী শহর। শহরটি আশ্চর্যজনকভাবে পর্যটন আকর্ষণ হয়ে চলেছে এবং এটি একই সাথে ইতিহাসবিদদের জন্য একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় আস্তানা। 

নীলনদ ও কায়রো 

নীল নদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আজও পর্যটকদেরকে তার কাছে টানে। নীল নদের তীরে গেলেই ক্রুজ ভ্রমণ, এর তীরে অবস্থিত পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একমাত্র অবশিষ্ট স্থাপনা গিজা পিরামিড এবং অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ মূর্তি স্ফিংক্স পরিদর্শন, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র লুক্সর এবং কর্মাক্স মন্দির এবং ভ্যালি অফ দ্য কিংস ফেরাউনের সমাধিস্থান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা পর্যটকদের পরিদর্শন যেন অবশ্য কর্তব্য়।

নীলনদের তীরে কায়রো শহর

কায়রোর গ্রেট গিজা পিরামিড

আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি সপ্তম আশ্চর্যের কথা। সপ্তম আশ্চর্যকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাচীন বিশ্ব, মধ্যযুগ এবং আধুনিক বিশ্ব। কায়রোর গ্রেট গিজা পিরামিড প্রাচীন বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একমাত্র নিদর্শন যা এখনো টিকে আছে। গিজা পিরামিড বলতে গিজার তিনটি প্রধান পিরামিডকে বুঝায়। যার মধ্যে রয়েছে সবচেয়ে বিখ্যাত ও বৃহত্তম খুফুর পিরামিড, দ্বিতীয় বৃহত্তম পিরামিড খাফর এবং মেনকউরের পিরামিড।

গ্রেট গিজা পিরামিড

এগুলো কোন সাধারণ স্থাপত্য নয়। এগুলো তৈরি হয়েছিল ফারাও খুফু-র সমাধি হিসেবে। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় এই ৪৮১ ফুট পিরামিড তৈরি হয়েছিল কোন টেকনোলজি ছাড়া শুধুমাত্র কায়িক শ্রম দিয়ে! এটি নির্মাণে প্রায় ২৩ লক্ষ পাথরের ব্লক ব্যবহৃত হয়েছে যার প্রত্যেকটির ওজন গড়ে ছিলো ২.৫ টন থেকে ১৫টন। এত ভারী পাথর এবং কোন প্রযুক্তি ছাড়া তারা কেমনে নির্মাণ করেছে এই নিয়ে এখনো রহস্য রয়ে গিয়েছে। কেউ মনে করেন শ্রমিকরা ঢালু রাম ব্যবহার করে পাথর উপরে তুলেছিল আবার কেউ কেউ বলে এটি প্রাচীন কোন উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে।

মূর্তি স্ফিংক্স 

গিজা পিরামিডের পাশেই অবস্থিত স্ফিংক্স। যাকে মনে করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন এবং বৃহত্তম পাথরের ভাস্কর্য। এটি একটি মাত্র বিশাল চুনাপাথর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। এর উচ্চতা ২৪০ ফুট লম্বা এবং ৬৬ ফুট উঁচু।

এই পৌরাণিক সৃষ্টির শরীরে নিচের অংশ সিংহাকৃতির এবং মাথা মানুষের মতন। তবে এর নাকভাঙ্গা। ধারণা করা হয় এটিকে মধ্যযুগে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছিল।মিশরের ঐতিহাসিকদের মতে, এটি ধর্মীয় বিরোধের কারণেও ভেঙে দেয়া হতে পারে।

মূর্তি স্ফিংক্স

স্ফিংক্স একটি কৌতূহলপূর্ণ ভাস্কর্য। একে নিয়ে রয়েছে নানা গল্প জড়িত। এর মুখ পূর্ব দিকে হওয়ায় অনেকে মনে করেন এটি সূর্য দেবতার প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। আবার বলা হয় স্ফিংক্সের সাথে গ্রিক পুরাণে ধাঁধার গল্প জড়িত আছে। গল্পে আছে গ্রীক স্ফিংক্স পথচারীদের ধাঁধা জিজ্ঞাসা করত এবং তারা সঠিক উত্তর না দিতে পারলে তাদের শাস্তি দিত। 

মজার ব্যাপার হচ্ছে বহু শতাব্দি ধরে স্ফিংক্সর বেশিরভাগ অংশ বালু নিচে চাপা ছিল যা পুরোপুরি খনন করতে প্রায় দুই হাজার বছর সময় লেগেছে। 

লুক্সর মন্দির 

লুক্সর মন্দিরের আকর্ষণীয় বিষয় হলো এটি বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রনের একটি অন্যতম উদাহরণ। এখানে সময়ের সাথে তৈরি হয়েছে তিনটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। প্রথমে মন্দিরটি ফারাও চতুর্থ আমেনহোটেপ আটেনের সূর্য দেবতাকে উৎসর্গ করে নির্মাণ করেছিলেন। 

লুক্সর মন্দিরের রাতের দৃশ্য

মধ্যযুগে রোমানরা মন্দিরের ভিতর একটি চার্চ তৈরি করেন, যা আজও দেখা যায়। ১২ শতকের দিকে এর ভিতরেই নির্মাণ করা হয় আবু আল-হাগগ মসজিদ। এটিই প্রমাণ করে মিশরের প্রাচীন মন্দির গুলো পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতি দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছিল। এই মন্দিরের পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ হল রাতের মনমুগ্ধকর আলোকসজ্জা।

কার্নাক মন্দির

মিশর মানে যেন প্রাচীন স্থাপত্যের জাদুঘর। কার্নাক মন্দিরও এমনই মিশরের অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহত্তম মন্দির কমপ্লেক্স। এটি শুধু মিশর নয়, গোটা বিশ্বের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শন।

কার্নাক মন্দির

২০০ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত এই মন্দির ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নির্মাণ করা হয়েছে। কার্নাক মন্দিরের সবচেয়ে বিখ্যাত অংশ হল হাইপোস্টাইল হল যেখানে ১৩৪টি বিশাল পিলার রয়েছে। প্রতিটি পিলার ১০০ মিটার অর্থাৎ ৬৯ ফুট পর্যন্ত উঁচু এবং পিলারের দেয়ালে খোদাই করা রয়েছে প্রাচীন মিশরের ধর্মের ঐতিহাসিক দৃশ্য।

মোহাম্মদ আলী মসজিদ

মোহাম্মদ আলী মসজিদ তার স্থাপত্য শৈলী ও ঐতিহাসিক কারণে পর্যটকদের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। মসজিদটি তৈরি করেছিলে মিশরের শাসক মোহাম্মদ আলী পাশা, যার নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৮২৮ সালে এবং সম্পন্ন হয় ১৮৪৮ সালে তার মৃত্যুর পর। এটি মোহাম্মদ আলী নিজেকে স্মরণিয় করে রাখার জন্য নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদের প্রত্যেকটি কোণা যেন তার ক্ষমতার প্রতীক এবং মিশরের আধুনিকীকরণের প্রতিফলন ।

মোহাম্মদ আলী মসজিদ ও কায়রো শহরের প্যানারোমিক দৃশ্য

এই মসজিদটির অভ্যন্তরে এবং বাইরের অংশে আলাবাস্টার পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। এজন্য একে আলাবাসটার মসজিদও বলা হয়। অ্যালাবাস্টার হল একটি খনিজ বা শিলা যা নরম, প্রায়শই খোদাই করার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং প্লাস্টার পাউডারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এ মসজিদটি কায়রোর প্রাচীন সালাদিন সিটাডেলের মধ্যে অবস্থিত, যা কায়রো শহরের অন্যতম উঁচু স্থান। এই জন্য এখান থেকে পুরো কায়রো শহরের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। 

খান এল-খলিলি বাজার

মিশরের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্র এবং সবচেয়ে প্রাণবন্ত একটি স্থান হল খান এল খলিলী বাজার। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৮২ সালে মিশরের মামলুক আমলে। এটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল যেখানে আরব, আফ্রিকা এবং ইউরোপের বণিকেরা জড়ো হতো কেনা বেচার উদ্দেশ্যে।

এই বাজারটিকেও মধ্যযুগীয় ইসলামিক স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। এখানে মসজিদ, মাদ্রাসা এবং পুরনো সরাইখানার ধ্বংসাবশেষ আজও দেখতে পাওয়া যায়। এই বাজারের নামকরণ করা হয়েছিল মামলুক আমলের শাসক জাহারকাস এল-খলিলী নামে, যিনি এই এলাকা পুনর্গঠন করেছিলেন।

খান এল-খলিলি বাজার

আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় 

মিশরের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় আল-আজহার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ৯৬০-৯৬২ সালে আত্মপ্রকাশ করে। আজও এটি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধর্মীয় বিদ্যাপীঠ যেখানে সারা পৃথিবী থেকে শিক্ষার্থী এসে থাকে। এর গ্রন্থাগারটিও প্রাচীন গ্রন্থে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ।

কেন আজ কায়রো আবর্জনা শহরে পরিণত হয়েছে 

খুবই দুঃখজনক হলেও সত্যি এই ঐতিহাসিক  সুন্দর শহর “আবর্জনা শহর” বলেও পরিচিত। জনসংখ্যার চাপ ও বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে আজ কায়রোকে আবর্জনা শহর বলা হচ্ছে। এখানকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি বড় অংশ নির্ভর করে মুকাত্তম এলাকার “জাবালিন” নামে পরিচিত একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর উপর। জাবালিনের বাসিন্দারা বর্জ্য সংগ্রহ করে এবং ৮০-৯০ শতাংশ পুনরায় ব্যবহারযোগ্য উপকরণকে আলাদা করে। তবে তারা মূলত অপরিকল্পিতভাবে কাজ করে। ফলে এ পুরো শহর এই অব্যবস্থাপনায় একটি বর্জ্যের শহরে পরিণত হয়েছে।

আবর্জনার শহর কায়রো

এই অঞ্চলেই ঢুকলেই নাকে বোটকা গন্ধ এসে লাগে। পরিতক্ত বিল্ডিং গুলোর আশেপাশের উপরে রয়েছে পরিত্যক্ত জিনিসপত্র এবং আবর্জনার স্তুপ। এরই মাঝে বসবাস করছে সে এলাকার জনগোষ্ঠী যাদের জীবনমান অত্যন্ত নিম্ন। এর ফলে সেখানে অনেক স্বাস্থ্যগত সমস্যারও সৃষ্টি হচ্ছে। আবর্জনার শহর একটি নেতিবাচক তকমা হলেও মুকাত্তম এলাকার এই জাবালিন জনগোষ্ঠীর কঠোর পরিশ্রম ও পুনঃব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত।

উপসংহার

কায়রোতে ঘুরতে যাওয়া মানে শুধু একটি শহর দেখা নয় বরং এক নতুন দুনিয়ায় প্রবেশ করা। এটি যেন সভ্যতার গভীরে এক ভ্রমণ যেখানে উপভোগ করা যায় ইতিহাস ও আধুনিকতার এক অদ্ভুত সুন্দর মিলন। প্রাচীন এই শহরটি যেন তাঁর সমস্যা দ্রুতই কাটিয়ে উঠে, আবার তাঁর অতীত গৌরব ফিরে পায়।  

কায়রো সম্পর্কে আরও কিছু মজার তথ্যঃ

১। কায়রোর বাচ্চাদের “গাধার গাড়ি” প্রেমঃ কায়রো শহরের কিছু অংশে এখনও গাধার গাড়ি ব্যবহৃত হয়। কায়রোর শিশুরা এই গাধার গাড়িতে চড়তে ভীষণ পছন্দ করে। এটি তাদের জীবনের ছোট ছোট আনন্দগুলোর একটি।

২। “উইংড ডিস্ক” পেট্রল পাম্পঃ কায়রোর পুরনো এলাকায় এখনো এমন কিছু পেট্রল পাম্প দেখতে পাওয়া যায়, যেগুলোর উপর “উইংড ডিস্ক” চিহ্নিত আছে। এটি মিশরের প্রাচীন সূর্য দেবতার প্রতীক।

৩। কায়রোর বিখ্যাত নীলের ব্রিজঃ কায়রোর নীল নদে অনেকগুলো ব্রিজ আছে, তবে কাসর আল-নিল ব্রিজ (Qasr al-Nil Bridge) সবচেয়ে বিখ্যাত। সন্ধ্যায় এখানে দাঁড়িয়ে শহরের আলোকিত সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

৫। রাত্রিকালীন পাখি বাজারঃ কায়রোতে এমন একটি বাজার আছে যেখানে রাতে পাখি বিক্রি হয়। এটি কেবল পাখির শৌখিন মালিকদের জন্য নয়, বরং ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 

৬। কায়রোতে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম ধনী জাদুঘরঃ মিশরের জাদুঘর (Egyptian Museum)-এ প্রাচীন মিশরের ১২০,০০০ এরও বেশি নিদর্শন রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কিং তুতাংখামেনের বিখ্যাত সোনার মুখোশ।

৭। বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো চিড়িয়াখানাঃ কায়রোর গিজা চিড়িয়াখানা, প্রতিষ্ঠিত ১৮৯১ সালে, আফ্রিকার অন্যতম পুরনো চিড়িয়াখানা এবং মিশরীয় শিশুদের কাছে এখনো একটি প্রিয় জায়গা।

৮। কায়রো- হাজার মসজিদের শহরঃ কায়রোতে এত বেশি মসজিদ রয়েছে যে এটি “City of a Thousand Minarets” নামে পরিচিত। প্রাচীন ও আধুনিক মসজিদগুলোর স্থাপত্য কায়রোর অন্যতম আকর্ষণ।

রেফারেন্স 

Related posts

পানামা খালের শহর-পানামা সিটি!

আবু সালেহ পিয়ার

মুর্শিদাবাদ: এক সমৃদ্ধশালী রাজধানীর পতন

কার্নিভালের রঙীন শহর-রিও ডি জেনিরো

ইসরাত জাহান ইরা

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More