Image default
কী ও কেন

গ্রহের গোলাকৃতি : মহাকর্ষ ও প্রকৃতির নিখুঁত গাণিতিক খেলা

মহাশূন্য; যেখানে মুক্তভাবে সবকিছু ভেসে বেড়ায়, সেখানে এত নিখুঁত গোলাকৃতি গ্রহ !! কীভাবে সম্ভব?

কখনো কি আকাশের দিকে তাকিয়ে ভেবেছেন পৃথিবীসহ সৌরজগতের অধিকাংশ গ্রহ গুলো গোল কেন? গ্রহগুলো কেন ত্রিভুজ, চৌকো বা অন্য কোনো আকৃতির নয়?

এই সাধারণ কিন্তু গভীর প্রশ্নের পেছনে লুকিয়ে আছে মহাবিশ্বের এক অসাধারণ বিজ্ঞান। এই আর্টিকেলে আমরা জানব কেন গ্রহগুলো সবসময় গোল হয় এবং এর পেছনের রহস্য কী?

গ্রহের প্রাথমিক গঠন ও আকৃতি

আমাদের এই সৌরজগতের সূচনা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে।  বিশাল গ্যাস ও ধুলোর মেঘ (nebula) থেকে সৌরজগতের উৎপত্তি। এই মেঘ ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে থাকে এবং মহাকর্ষ বলের প্রভাবে কেন্দ্রস্থলে গঠিত হয় সূর্য।

চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ধুলো ও গ্যাস জমে তৈরি হতে থাকে গ্রহ এবং অন্যান্য বস্তু। গ্রহ হলো একটি মহাকাশীয় বস্তু; যা সূর্যের চারপাশের কক্ষপথে ঘুরে। গ্রহ মূলত তিনটি স্তরে গঠিত ।

গ্রহের তিনটি স্তর

কেন্দ্রীয় বা কঠিন অংশ, মেন্টল বা মাঝের স্তর এবং বাইরের পাতলা স্তর বা মণ্ডল। 

প্রতিটি গ্রহের শুরু হয়েছিল অনিয়মিত আকারে। তবে সময়ের সাথে সাথে তাদের আকৃতি বদলে যায় এবং এই গ্রহ গুলো গোল হতে শুরু করে।

কিন্তু কিভাবে গ্রহের আকৃতি কিভাবে গোল হলো? চলুন জেনে নিই।

মহাকর্ষ বল যেভাবে গ্রহকে গোল করে

গ্রহের গোলাকার হওয়ার পেছনে প্রধান চালিকা শক্তি হলো মহাকর্ষ। মহাকর্ষ হচ্ছে এমন এক বল যা সব বস্তুকে কেন্দ্রবিন্দুর দিকে টানে। যখন একটি বস্তু যেমন- গ্রহ পর্যাপ্ত ভর পায়, তখন তার নিজস্ব মহাকর্ষ বল তার সমস্ত অংশকে একে অপরের দিকে টেনে আনে। এর ফলে বস্তুটি এমন একটি আকৃতিতে এসে পৌঁছায় যেখানে সবদিক থেকে টান সমান থাকে অর্থাৎ গোলাকৃতি।

গোল আকৃতি হলো ভারসাম্যের সর্বোত্তম অবস্থা। এটি এমন এক আকৃতি যেখানে গ্রহের প্রতিটি অংশ সমানভাবে কেন্দ্রের দিকে টানা হয়। যার ফলে গ্রহের আকার স্থিতিশীল থাকে। গ্রহ পর্যাপ্ত ভর পেলে নিজেই গড়িয়ে এসে গোল হয়ে যায়।

গ্রহ গোল হওয়ার প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা

একটি বস্তু যখন বড় হয় তখন তার অভ্যন্তরের উপাদানগুলো তরলের মতো আচরণ করতে শুরু করে। এবং বস্তুটি তার নিজের মহাকর্ষ বলের ভারে গোল আকার ধারণ করে। এই প্রক্রিয়াকে বলে হাইড্রোস্ট্যাটিক ইকুইলিব্রিয়াম। এটি একটি অবস্থান যেখানে বস্তুটি নিজের অভ্যন্তরীণ চাপ ও মহাকর্ষ শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে গোল হয়ে ওঠে।

যদি গ্রহগুলো গোল না হত তাহলে আমাদের পৃথিবীতে কি হতো? 

গ্রহ গোল না হলে কী হতো?

প্রথমত মহাকর্ষের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেত। অসম আকৃতির গ্রহে মহাকর্ষ সব জায়গায় সমান হতো না। যার ফলে বাতাস ও পানি একদিকে জমে অন্যদিকে ফাঁকা থাকে। ফলে টিকে থাকা অনেক কঠিন হতো। তাছাড়াও গ্রহের গোলাকৃতির কারণে পৃথিবীর ঘূর্ণন এবং আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণে থাকে, যা জীবনধারণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সব গ্রহ কি পুরোপুরি গোল?

যদিও আমরা বলি গ্রহগুলো গোল আসলে তারা নিখুঁত গোল নয়। গ্রহগুলো সাধারণত গোল হলেও তারা ১০০% নিখুঁত গোল নয়। উদাহরণস্বরূপ পৃথিবী একটি অবলেট স্ফেরয়েড, মানে একটু চ্যাপ্টা গোল। এটি এমন এক আকৃতি যেখানে মেরুর দিকগুলো কিছুটা চ্যাপ্টা আর ইকুয়েটরের দিকটা একটু ফুলে ওঠা।

এর পেছনের কারণ হলো পৃথিবীর ঘূর্ণন। যখন একটি গ্রহ নিজের অক্ষে ঘোরে তখন ঘূর্ণনের কারণে কেন্দ্রবিমুখ বল তৈরি হয়। যা বস্তুটিকে কেন্দ্র থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করে। এই বল ইকুয়েটর অঞ্চলে বেশি প্রভাব ফেলে। ফলে সেখানে কিছুটা স্ফীত হয়ে যায়।

বৃহস্পতি যেহেতু পৃথিবীর চেয়ে অনেক দ্রুত ঘোরে তাই তার চ্যাপ্টাভাব আরও বেশি। তবে সৌরজগতে কিছু ব্যতিক্রম গ্রহ আছে যেগুলো কিছুটা অসম প্রকৃতির। চলুন সেসব ব্যতিক্রম গ্রহ সম্পর্কে জেনে নিই।

ব্যতিক্রমী আকৃতির গ্রহ বা বামন গ্রহ

বামন গ্রহ

প্লুটো বা সিরেসের মতো বামন গ্রহগুলিও অনেকটা গোল হলেও তারা কিছুটা অসম হয়। কারণ এরা হাইড্রোস্ট্যাটিক ইকুইলিব্রিয়ামে আসার মতো পর্যাপ্ত ভর বা তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারেনা। এই দিক থেকে তারা গোলত্বের এক মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে।

তাহলে ছোট ছোট উপগ্রহ বা গ্রহাণু কেন গোল নয়?

ছোট বস্তু ও গ্রহাণুর গোল না হওয়ার কারণ

এর কারণ হলো ছোট বস্তুর ভর অনেক কম হয়। যার ফলে তাদের মহাকর্ষ বলও দুর্বল। তাদের নিজস্ব শক্তি এতটাই কম যে তারা নিজেদের আকৃতি গুছিয়ে গোল করে তুলতে পারে না। তাই এসব ছোট বস্তুর গঠন হয় এলোমেলো, অসম ও কখনো কখনো পাথরের টুকরোর মতো খসখসে।

গ্রহের গোলত্ব ও মহাকাশ প্রযুক্তি

গ্রহ গোল হওয়ায় বিজ্ঞানীরা সহজে তাদের কক্ষপথ নির্ণয় করতে পারেন। কক্ষপথ হিসাব করার জন্য প্রয়োজন হয় একটি নির্দিষ্ট আকৃতি। যাতে উপগ্রহ বা মহাকাশযান নির্দিষ্ট নিয়মে ঘুরতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ GPS সিস্টেম পৃথিবীর গোলাকৃতি বুঝেই কাজ করে। যদি পৃথিবী সমতল হতো তাহলে GPS কখনোই নির্ভুলভাবে দিক বা অবস্থান নির্দেশ করতে পারত না।

বিজ্ঞানে ও মহাকাশ অভিযানে এর প্রভাব

গ্রহের গোলাকৃতি বৈশিষ্ট্যর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা সহজেই কক্ষপথ গণনা করতে পারেন। যা স্যাটেলাইট স্থাপন, রকেট উৎক্ষেপণ কিংবা মঙ্গল মিশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গোলাকার আকৃতি থাকায় কক্ষপথ পূর্বানুমানযোগ্য এবং সিমেট্রিক হয়। এমনকি যেকোনো মিশনের পরিকল্পনায় সুবিধা দেয়।

গোলাকার বনাম অন্য আকৃতি- বৈজ্ঞানিক সত্য বনাম ভ্রান্ত ধারণা 

বর্তমানে ইন্টারনেটে অনেকেই “ফ্ল্যাট আর্থ” বা সমতল পৃথিবী নিয়ে তত্ত্ব প্রচার করেন। কিন্তু এই ধারণা একেবারেই বৈজ্ঞানিক নয়। আজকের দিনে মহাকাশ থেকে তোলা হাজার হাজার ছবিতে দেখা যায় পৃথিবী গোল এবং সেটিই বাস্তব। GPS, স্যাটেলাইট, এবং মহাকাশ অভিযান সবকিছু প্রমাণ করে যে, পৃথিবী গোল এবং এ নিয়ে সন্দেহের কোনো জায়গা নেই। এসব ধারণা বিজ্ঞানের আলোকে শুধু ভুলই নয় বরং বিভ্রান্তিকর।

গ্রহের গোলাকৃতি কেবল একটি জ্যামিতিক বিষয় নয়‌, বরং এটি মহাবিশ্বের গভীর গাণিতিক ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের প্রতিফলন। মহাকর্ষ, ঘূর্ণন, ও পদার্থের ধর্ম মিলিয়ে তৈরি হয় এই আশ্চর্য সুষম আকৃতি। গ্রহগুলো গোল বলেই আমরা GPS ব্যবহার করতে পারি, মহাকাশযান পাঠাতে পারি। এবং সবচেয়ে বড় কথা এই গোল পৃথিবীতে ভারসাম্যপূর্ণ জীবন টিকিয়ে রাখতে পারি। প্রকৃতির এই নিখুঁত ডিজাইন আমাদেরকে সবসময় বিস্মিত করে।

তথ্যসূত্র-

https://www.bigganchinta.com/cause/c3e0gbfra2 

https://www.britannica.com/story/why-are-planets-round 

https://statewatch.net/post/37452 

Related posts

প্লুটো: কেন একে রহস্যময় গ্রহ বলা হয়

কেন বাড়ি ভাড়া বাড়তেই থাকে? বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির কারণ ও সমাধান

পোপ নির্বাচনের রহস্যময় পদ্ধতি- পোপ ফ্রান্সিসের পর যেভাবে নির্বাচিত হবেন নতুন পোপ

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More