Image default
রহস্য রোমাঞ্চ

সোকোত্রা: পৃথিবীর বুকেই লুকানো এক ‘এলিয়েন দ্বীপ’

দ্বীপের কোথাও ছাতার মতো গাছ, আবার কোথাও দেখা যায় খর্বাকৃতির গাছ। কোনো গাছ পাতাহীন, কিন্তু গাছের প্রতিটি ডালে ফুল ফুটে আছে। এ যেন কোনো ভিনগ্রহের আবাসভূমি।

অন্যান্য গ্রহে প্রাণের খোঁজ বিজ্ঞানের অন্যতম আগ্রহের বিষয়। তবে ভাবুন তো, এই পৃথিবীতেই যদি এমন কোনো এলিয়েন রাজ্য খুঁজে পাওয়া যায়? 

আরব সাগরের বুকে রয়েছে এমনই এক রহস্যময় দ্বীপ — সোকোত্রা, যাকে বলা হয় ‘এলিয়েন আইল্যান্ড’। ভিন্নধর্মী গাছপালা ও বৈচিত্র্যময় ভৌগলিক পরিবেশের কারণে এটি দেখতে যেন অন্য গ্রহের কোনো ভূমি। কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে পরিত্যক্ত ও মানব জ্ঞানসীমার বাইরে থাকা এই দ্বীপকে পুনরায় আবিষ্কার করা হয়েছে, আর এখন সেখানে মানব বসতিও গড়ে উঠেছে।

সাইফাই সিনেমার মতো সোকোত্রা দ্বীপ

সোকোত্রা, আব্দ আল কুরি, সামহা ও ডারসা- এই চারটি দ্বীপ মিলে তৈরি হয়েছে সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জ। এই দ্বীপের আয়তন ৩৭৯৬ বর্গ কিলোমিটার। এটি প্রায় ১৩২ কিলোমিটার লম্বা এবং ৫০ কিলোমিটার চওড়া। এর রাজধানীর নাম হাদিবু। 

সোকোট্রাসহ চারটি দ্বীপে মোট ৬০ হাজার মানুষের বসবাস। প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ১১.৩ জন মানুষ বাস করে। অর্থাৎ, এলাকা অনুযায়ী জনসংখ্যা কম। প্রাচীনকালে এটি গন্ডোয়ানা মহাদেশের অংশ ছিল এবং পরে আফ্রিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বর্তমান অবস্থানে থেমে যায়। এই দ্বীপপুঞ্জে আরও দুটি ছোট পাথুরে দ্বীপ রয়েছে, যেখানে মানুষের নয়, সামুদ্রিক পাখির বাস।

সোকোত্রা দ্বীপের ইতিহাস

সোকোত্রার অনন্য সংস্কৃতি আজ বিলুপ্তির পথে। সোকোট্রি ভাষা, প্রাকৃতিক ওষুধ, মাছ ধরা ও ঐতিহ্যবাহী জীবিকা এখন হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের কোনো লিখিত ভাষা না থাকায়, বিদেশিদের রেকর্ডই সোকোত্রার ইতিহাস জানার একমাত্র উপায়।

দ্বীপটি একসময় ভারতীয়, গ্রীক, পর্তুগিজ, ওমানি ও ব্রিটিশদের শাসনে ছিল এবং ভারত মহাসাগর পাড়ি দেওয়া নাবিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। হক গুহাসহ নানা স্থানে শিলালিপিতে তার প্রমাণ মেলে।

সুকাত্রি সংস্কৃতিতে গান ও কবিতার মাধ্যমে ভাব বিনিময় ছিল সাধারণ বিষয়। নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবনকাহিনীও মৌখিক কবিতার মাধ্যমে এই স্থানে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে গেছে। এই দ্বীপের প্রাচীনতম সুকাত্রি কবি ফাতিমা-আল-সুকুত্রিয়া ৯ম শতাব্দীর বলে ধারণা করা হয়। তাঁর লেখা ‘টেলিমেথেল’ নামে চার লাইনের ছোট ছোট লোককাহিনীভিত্তিক কবিতাগুলো ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়।

সোকোত্রার মানুষ

ইয়েমেনের সোকোত্রা দ্বীপের অদ্ভুত গাছপালা

এই দ্বীপ জুড়ে বিরল প্রজাতির নানা উদ্ভিদের দেখা মেলে। দ্বীপের কোথাও ছাতার মতো গাছ, আবার কোথাও দেখা যায় খর্বাকৃতির গাছ। কোনো গাছ পাতাহীন, কিন্তু গাছের প্রতিটি ডালে ফুল ফুটে আছে। এ যেন কোনো ভিনগ্রহের আবাসভূমি। সোকোত্রা দ্বীপে ৮২৫ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ৩০৭টি প্রজাতিই স্থানীয়।

এখানের অধিকাংশ গাছপালা প্রায় ২ কোটি বছরের পুরনো,  এই গাছগুলো এখনও কীভাবে শুধুমাত্র পৃথিবীর এই অংশেই টিকে রয়েছে, তা-ও বিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত বিস্ময়ের। এখানে আসা বিজ্ঞানী, গবেষকদের দাবি, এই দ্বীপে প্রায় ৮০০ রকমের বিরল প্রজাতির প্রাণী আর গাছপালা রয়েছে, যা বিশ্বের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। দ্বীপের গাছপালা দেখে মনে হয় হলিউডের সাইফাই মুভিতে দেখানো কাল্পনিক জগৎ।

সোকোত্রা দ্বীপের অদ্ভুত গাছপালা

সোকোত্রা দ্বীপ কেন পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত স্থান

বিশেষ ধরনের উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ইউনেস্কো সোকোত্রাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় ‘সোকোত্রা’ অর্থ ‘স্বর্গীয় আনন্দ’। 

দ্বীপটির ৮২৫ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ৩৭%, সরীসৃপের ৯০% এবং স্থল শামুকের ৯৫% প্রজাতি অন্য কোথাও দেখা যায় না। ভিনগ্রহের মতো অদ্ভুত এই দ্বীপ ২০০৮ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

ড্রাগন ব্লাড ট্রি

সোকোত্রার অন্যতম আকর্ষণ ড্রাগন ব্লাড ট্রি (Dracaena cinnabari) ছাতার মতো আকৃতির একটি গাছ, যা থেকে লাল আঠালো রেজিন বের হয়। এই রেজিন রঙ, বার্নিশ, ওষুধ ও প্রসাধনী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। শুষ্ক আবহাওয়ায় বেঁচে থাকার জন্য গাছটি ডালপালা ছড়িয়ে আর্দ্রতা সংগ্রহ করে। দশ বছরে মাত্র ৩ ফুট বাড়ে, ১৫ বছরে সাদা ফুল ফোটে, এবং বছরে একবারই ফুল দেয়। আশ্চর্যজনকভাবে, এ গাছ শত শত বছর বাঁচতে পারে।

সোকোত্রা দ্বীপ এ গাছটিকে ‘দাম-আল-আখওয়াইন’ নামে ডেকে থাকে। ড্রাগনের রক্তবৃক্ষের জন্মরহস্য নিয়ে অদ্ভুত দুটি লোকগাঁথাও শোনা যায় আরবদের মুখে। আরবি শব্দ ‘দাম আল-আখাওয়াইন’ এর অর্থ হলো‘দুই ভাইয়ের রক্ত’। রূপকথার শুরুটাও এখান থেকেই। বলা হয়, প্রথম ড্রাগনের রক্তবৃক্ষটি ঠিক সেই স্থানে জন্মেছিল যেখানে দুই ভাই ‘দারসা ও সামহা’ একে অপরের সঙ্গে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়াই করেছিল। 

এছাড়া গ্রিক পুরান কথায় কথিত আছে, একদা মহাবীর হারকিউলিসকে হেসপেরাইডস-এর বাগান থেকে তিনটে সোনার আপেল ফিরিয়ে নিয়ে আনতে হত। কিন্তু এই আপেল পাহারা দিচ্ছিল শক্তিশালী বিশালদেহী এক শতমুখী ড্রাগন। যার নাম ল্যান্ডন।

ড্রাগনকে না মেরে আপেল ফিরিয়ে আনা অসম্ভব ছিল। কিন্তু স্বয়ং হারকিউলিস যখন যোদ্ধা, তখন শত্রুকে পরাজিত হতে হবেই। হারকিউলিসের সঙ্গে যুদ্ধে ড্রাগনটির মৃত্যু হয়। তার গাঢ় লাল রক্ত ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। পরবর্তীতে সেই রক্ত থেকেই নাকি এই ড্রাগন ট্রির জন্ম। 

ড্রাগন ব্লাড ট্রি

ডেন্ড্রোসসিয়াস

ডেন্ড্রোসসিয়াস হলো সোকোত্রার এক বিশেষ শশা জাতীয় উদ্ভিদ। লম্বা কান্ডের চূড়ায় গোলাপি ও হলুদ ফুল ফোটে। উভলিঙ্গ এই গাছ দ্বীপের চেয়ে দ্বিগুণ প্রাচীন বলে ধারণা করা হয়। ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এদের বংশবিস্তারে সহায়ক। এর অদ্ভুত গড়নই সোকোত্রাকে ভিনগ্রহের দ্বীপ বলে মনে করার অন্যতম কারণ।

ডেন্ড্রোসসিয়াস

পোমেগ্র্যানেট

সোকোত্রার বিশেষ ফুলেল উদ্ভিদ পোমেগ্র্যানেট ২.৫ থেকে ৪ ফুট লম্বা হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে গোলাপি বা লাল ফুল ও হলদে-সবুজ ফল ধরে। শক্ত কাঠের জন্য এটি ছোট আসবাব তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। যদিও এটি সোকোত্রার স্থানীয় উদ্ভিদ, তবে হাওয়াইতেও এর চাষের চেষ্টা চলছে।

পোমেগ্র্যানেট

সোকোত্রার অজানা তথ্য

সোকোত্রার সাদা বালির সৈকত ও উষ্ণ আবহাওয়া দ্বীপটিকে ভিনগ্রহের মতো করে তোলে। উপকূলজুড়ে জেলে সম্প্রদায়ের বসতি ও মাছ ধরার নৌকা দেখা যায়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে নৌকায় করে আশপাশের দ্বীপ ঘোরা যায় এবং দেখা মেলে ডলফিন, তিমি ও নানা প্রজাতির মাছের।

দ্বীপের দক্ষিণে হাবিদুর উত্তরে বিস্তৃত হাজহির পর্বত দ্বীপের প্রায় অর্ধেক জুড়ে রয়েছে। গ্রানাইটের এই পাহাড় ঘিরে কুয়াশার আবরণ এক রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করে। দ্বীপের সর্বোচ্চ পর্বত মাশানিগ, যার উচ্চতা ১৫০০ মিটার—হাইকিংয়ের জন্য জনপ্রিয়। পাহাড়জুড়ে রয়েছে গুহা ও স্ট্যাল্যাক্টাইট-স্ট্যাল্যাগমাইটের গঠন।

সোকোত্রার সাদা বালির সৈকত

সোকোত্রা দ্বীপে ভ্রমণ করা কতটা নিরাপদ

সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণপিয়াসুদের জন্য এক নিরাপদ ও অনন্য গন্তব্য, বিশেষত যাদের অদ্ভুত ও বিরল প্রকৃতি দেখার আগ্রহ আছে। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মৌসুমি ঝড়ের কারণে যাওয়া সম্ভব না হলেও, বছরের বাকি সময় জাহাজ বা বিমানে যাওয়া যায়। ১৯৯৯ সালে চালু হওয়া বিমানবন্দর দ্বীপকে বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত করেছে, যা প্রধান শহর থেকে ১২ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত।

দ্বীপে পরিবহন ব্যবস্থা সীমিত—দুই-একটি মিনিবাস ছাড়া কিছু নেই। ইকোসিস্টেম রক্ষায় গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত, তাই ভ্রমণের বেশিরভাগ অংশেই হাঁটতে হয়।

তথ্যসূত্রঃ

Related posts

কবর নাকি গোপন ষড়যন্ত্র: জন এফ কেনেডির সমাধি

কেন জাপানের ড্রাগন’স ট্রায়াঙ্গেলে সবকিছু নিখোঁজ হয়ে যায়?

দাশত-ই লুত: পৃথিবীর উষ্ণতম মরুভূমি

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More