Image default
ইতিহাস ১০১

গালি’র ইতিহাস : ভাষা ও সংস্কৃতির অংশ এবং আবেগ প্রকাশের মাধ্যম

এক দেশে যা পাপ গণ্য, অন্য দেশে পূণ্য তাহাই

‘গালি দেয়া আপনার জন্য ভালো!’ একথা শুনে একটু অবাক লাগছে না? লাগারই কথা। গালি আবার ভালো জিনিস নাকি! হ্যাঁ কখনো কখনো গালি ভালো ভাষাও বটে।

আমরা রাগে-ক্ষোভে ঠোঁট কামড়ে কেউ হঠাৎ বলে বসি `শালা’! আবার বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় হাসতে হাসতে চলতে থাকে একের পর এক রসিক গালি। রাস্তার মোড়ে রিকশাওয়ালার গলায় গালি যেমন ঝাঁঝালো, তেমনি ফেসবুকে কীবোর্ড যোদ্ধার টাইপ করা গালিও কিন্তু কম নয়।

আসলে আপনি যখন গালি দেন, সেটা একটা আনন্দ, চরম বিস্ময়, বা গভীর দুঃখ, বেদনা, বা ক্রোধ যে কোন রকম পরিস্থিতিতেই হতে পারে। মনে হয়, আপনার আবেগ প্রকাশ করার জন্য এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত উপায়, প্রশ্নটা কিন্তু গভীর—কেন মানুষ গালি দেয়? কেন আমরা শব্দ দিয়ে কারও গায়ে আঘাত করি, বা উল্টোভাবে বললে—শব্দ দিয়েই নিজের রাগ, দুঃখ, কিংবা ভয় প্রকাশ করি?

অনেকেই ভাবেন, গালি একটা বাজে অভ্যাস, সামাজিক শালীনতার পরিপন্থী। কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজতাত্ত্বিকরা বলছেন অন্য কথা। তারা বলছেন, গালি হলো মানব সমাজের একটি সাংস্কৃতিক ভাষা, যা সময়ের সাথে বদলেছে, সমাজের আয়নায় প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেছে। শুধু কি তাই? মনোবিজ্ঞানের ভাষায় রয়েছে গালির মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা।

এই লেখায় আমরা খুঁজে দেখবো গালির ইতিহাস কোথা থেকে শুরু, গালি কিভাবে মানুষের ভাষায় ঢুকে পড়লো, বাংলা গালির সামাজিক প্রভাব, এবং গালিকে কেন বাজে ভাষা বলা হয়—তারও পেছনের সমাজ ও মানসিক বাস্তবতাগুলো।

বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বসে হাসতে হাসতে একজন গালি দিচ্ছে

কোথা থেকে শুরু গালির যাত্রা

গালি আধুনিক সমাজের নতুন কিছু নয়। গালির অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাই মানব সভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শনগুলোতেও। প্রাচীন গ্রিক নাটক, রোমান ব্যঙ্গচিত্র, বা ভারতীয় মহাকাব্যে নানা ধরনের আপত্তিকর ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের নজির রয়েছে। রোমানদের মধ্যে ‘invectiva‘ নামে একটি কাব্যিক গালি ব্যবহৃত হতো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হেয় করতে। গালিকে তারা মনে করত শক্তির প্রকাশ। ভারতে, মহাভারতে দ্রৌপদীর চুল টানা বা কুন্তীর জন্ম নিয়ে কৌতুকও একধরনের গালির রূপ। প্রাচীন সমাজে গালিকে ব্যবহার করা হতো সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষকে হেয় করতে। তবে এখন আর শুধু কাউকে হেয় করতেই গালি ব্যবহার করা হয় না। বন্ধুদের আড্ডায় বসে মজা করেও গালি দেওয়া হয় বন্ধুকে।

সুতরাং, গালির ইতিহাস একধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাষার বিকাশ, যা বিভিন্ন সভ্যতার আত্মপ্রকাশের অংশ।

গালি কিভাবে মানুষের ভাষায় এলো

ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, গালি ভাষার সবচেয়ে প্রাচীন এবং প্রাকৃতিক রূপগুলোর একটি। গালি মানুষের মস্তিষ্কের আবেগজনিত অংশ যেমন অ্যামিগডালা ও লিম্বিক সিস্টেম থেকে উঠে আসে। এটি কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ভাষা নয় বরং একপ্রকার ‘আবেগীয় স্বতঃস্ফূর্ত ভাষা’, যা মানুষ তার রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধ এমকি ভালোবাস বহিঃপ্রকাশেও ব্যবহার করে থাকে ।

মস্তিষ্কের আবেগজনিত অংশ যেখান থেকে গালি উৎপন্ন হয়

মনোবিজ্ঞানী টিমোথি জে বলেন, গালি হচ্ছে ‘এক্সপ্লেটিভ’ ভাষা—যার উদ্দেশ্য যুক্তির নয়, আবেগের বহিঃপ্রকাশ। কেউ হাত ভেঙে ফেললে যেমন চিৎকার করে, তেমনি মনের ব্যথা প্রকাশেও কেউ কেউ গালি দেয়।

প্রাচীন সমাজে গালি ছিলো সাংস্কৃতিক চর্চা

প্রাচীন সমাজেও গালির প্রয়োগ হতো। তখন গালি শুধু রাগ বা অপমানের ভাষা ছিল না। বরং তা ছিল একটি সাংস্কৃতিক চর্চাও। গ্রীক নাটকে যেমন ব্যঙ্গাত্মক গালির ব্যবহার হতো মানুষের দুর্বলতা বা সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে, তেমনই প্রাচীন ভারতীয় নাট্যকলা বা লোককবিতায়ও দেখা যায় রঙ্গতামাশার মাধ্যমে গালির প্রকাশ। বাংলা লোকসাহিত্যে যেমন বাউল, ভাটিয়ালি কিংবা পালাগানে গালির ব্যবহার হয়েছে হাস্যরস তৈরির জন্য।

বাংলা উনিশ শতক পর্যস্ত অশ্লীলতার বিষয়টি যখনই বড়ো হয়ে উঠেছে, তখন সব সময়ই সেটা বিষয়গত অশ্লীলতা, যা অনেকটা সাধারণ ভাষা হিসেবেই থেকে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ষোড়শ শতক থেকে বাংলাদেশে এক শুদ্ধ রুচির মানসিকতার উদ্ভব যার প্রভাব পড়েছে সেকালের পুথির ওপরেও। প্রাচীন সমাজে গালি ছিল প্রকাশের একটি শিল্পময় উপায়।

বাংলা গালির উৎস ও ব্যবহার

বাংলা গালির উৎস নির্দিষ্ট করে বলাটা মুশকিলই বটে। বাংলা গালির উৎস খুঁজলে দেখা যাবে, এই ভাষার গালিগুলো মূলত কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে গঠিত:

১. যৌনতা

২. নারী দেহ ও নারীত্ব

৩. পারিবারিক সম্পর্ক (বিশেষ করে মা-বোন)

৪. পেশা ও জাতপাত

৫. ধর্ম ও সামাজিক শ্রেণি

এই গালিগুলো বাংলার পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেমন, একজন পুরুষকে গাল দিতে হলে তার মাকে বা বোনকে হেয় করেই অপমান করা হয়।

বাংলার শহুরে গালিতে বেশি পাওয়া যায় রাজনৈতিক বা যৌনতার বিষয়কে। গ্রামীণ গালিতে থাকে কৃষিকাজ বা গরিবি নিয়ে বিদ্রুপ। বাঙালির হাস্যরসে গালির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে—তা হোক ব্যঙ্গচিত্রে, নাটকে কিংবা কৌতুকনির্ভর সাহিত্যে।

গালিকে কেন বাজে ভাষা বলা হয়

সমাজের নৈতিক ও ধর্মীয় মানদণ্ড অনুযায়ী গালিকে সাধারণত ‘অশ্লীল’ বা ‘অভদ্র’ বলা হয়। বহু সংস্কৃতিতেই যৌনতা, শরীর, ধর্ম ও নারীত্ব সংক্রান্ত শব্দগুলো ‘ট্যাবু’ বা নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে বিবেচিত। আসলে, কোনো শব্দের ‘অশ্লীল’ হওয়া নির্ভর করে সমাজে সেই শব্দের বিপজ্জনক বা গোপনীয় অবস্থান অনুযায়ী।

ধর্মীয় শিক্ষায়, যেমন ইসলামে ও হিন্দু ধর্মে, মুখে অপমানজনক বা নোংরা শব্দ ব্যবহার করা পাপ। ফলে গালি সমাজে ‘বাজে ভাষা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। 

ভাষার বিকাশে গালির ভূমিকা

মানুষের ভাষা কখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। যদিও ভাষার বিবর্তনের গতি খুব দ্রুত না হওয়ায় অনেক সময় সে বিবর্তন একটি বিশেষ কালের সাপেক্ষে চোখে পড়ে না, তবু যে সতত পরিবর্তনশীল তা ভাষাতাত্ত্বিকরা সকলেই স্বীকার করেন। দীর্ঘকাল ধরে এমন একটা ভাবনা ক্রমাগত চলে আসছে যে ভাষার হচ্ছে।

ভাষার বিবর্তনে গালি গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তর। কারণ, গালি ভাষার একধরনের পরোক্ষ বিবৃতি, রূপক, ব্যঙ্গ, এমনকি কাব্যও। সাহিত্যিকরা যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা সৈয়দ মুজতবা আলী কখনো কখনো গালির ব্যবহারে চরিত্রের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। এর মাধ্যমে ভাষার পরিধি প্রসারিত হয়েছে। যদিও তা বেশির ভাগ সময়েই রুপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

গালি কিছু সময় “স্ল্যাং” রূপে পরিণত হয়ে ভাষার একটি উপশাখা তৈরি করে, যা নতুন প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়। তাইতো নতুন প্রজন্ম আনন্দের সময়ও গালি দিয়ে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।

গালির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা : মানুষের আবেগ প্রকাশের উপায়

মানুষ গালি দিয়ে আরাম পায়, কিন্তু কেন? এটা কি আমরা জেনে বুঝেই করি, নাকি আমরা যখন অশিষ্ট ভাষা ব্যবহার করি তখন আমাদের মস্তিষ্কে এবং দেহে সত্যি কিছু একটা পরিবর্তন হয়? 

গালির প্রধান কাজ হচ্ছে আবেগ নির্গমন। যেমন, রাগ, দুঃখ, হতাশা, আনন্দ, এমনকি ভয় থেকেও মানুষ গালি দেয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, গালি মানুষের শরীরে স্ট্রেস হরমোন কমায় এবং ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ায়। এক গবেষণায় দেখা যায়, ব্যথা পাওয়ার সময় যারা গালি দেন, তারা তুলনামূলকভাবে ব্যথা বেশি সহ্য করতে পারেন।

একজন নারী পুরুষকে গালি দিয়ে স্বস্তি পাছে

কারো হয়তো মস্তিষ্কের বাম দিকের অংশ কেটে বাদ দেয়া হয়েছে, বা স্ট্রোকের মতো কোনো কারণে মস্তিষ্কের বাম দিক গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার ফলে সে হয়তো কথা বলার ক্ষমতা বা ভাষার অনেকটাই হারিয়ে ফেলে, কিন্তু তখনো সে গালি দিতে পারে।

এতে মনে হয়, কিছু ধরনের কথার সাথে আমাদের আবেগের খুব জোরালো সম্পর্ক আছে, এবং সেগুলো আমাদের মস্তিষ্কের ভিন্ন কোন একটা জায়গায় জমা থাকে। সে কারণেই মস্তিষ্কের কিছু অংশ কেটে বাদ দিলে তার সাধারণ ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা কমে যায়, কিন্তু স্বত:স্ফূর্তভাবে গালি দেবার ক্ষমতাটা ঠিকই রয়ে যায়।

গালি দেয়াটা আমাদের আবেগের সঙ্গে এত গভীরভাবে সম্পর্কিত যে ওই শব্দগুলো উচ্চারণের জন্য যে মাংসপেশীর নড়াচড়ার দরকার হয়, তা একাধিক জায়গায় ধারণ করা থাকে। যাতে দরকার মতো ব্যবহারের জন্য ‘ব্যাকআপ’ থাকে।

এছাড়া গালি অনেক সময় আত্মবিশ্বাস ও প্রতিরোধ গড়ার অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে নিম্নবর্গের বা নির্যাতিত শ্রেণির মধ্যে।

এক দেশে যা পাপ গণ্য, অন্য দেশে পূণ্য তাহাই

বাংলা একটা কথা প্রচলিত আছে, এক দেশের বুলি আর আরেক দেশের গালি। অর্থাৎ একটা সমাজে বা রাষ্ট্রে যা গালি হিসেবে বিবেচিত অন্য কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে তা গালি হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে। গালির বিষয়বস্তু এবং কাঠামো সংস্কৃতি ও সমাজভেদে ভিন্ন।

আমরা ‘বাল’ শব্দটাকেই উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি। হিন্দিতে ‘বাল’ চুল আর বাংলা তার অর্থ দাঁড়িয়েছে যৌনাঙ্গের চুল বা এক ধরনের গালি। এখন হিন্দি ভাষাভাষী কোনো মানুষ যদি বাংলা ভাষী কোনো মানুষকে বলে ‘এখানে বাল কাটনেওয়ালা কোথায় পাওয়া যাবে?’ তাহলেই রীতিমত গণ্ডগোল বেধে যারে তার সঙ্গে। তাই সমাজ, সংস্কৃতি এবং বিষয়বস্তু ভেদে গালির ভিন্নতা রয়েছে।

গালিও এক ধরনের সংস্কৃতি

এই লেখাটা লিখতে গিয়ে একটা সিনেমার কথা মনে পড়ে গেলো। Netflix-এ History of Swear Words নামে একটি ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম। সেখানে দেখানো হয়েছিলো কিভাবে গালি পাশ্চাত্য সমাজে সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। এবং এটা শুধু পাশ্চাত্য সমাজে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সমাজেই গালি সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।

History of Swear Words মুভির পোস্টার

গালি শুধু ভাষা নয়, এটি সাংস্কৃতিক উপাদান। বাংলা সিনেমায় গালি ব্যবহারের ইতিহাস শুরু হয় লোকজ ও সামাজিক চিত্রায়নের মধ্য দিয়ে। আজকের গান বা স্ট্যান্ডআপ কমেডিতেও ‘কন্ট্রোল্ড গালি’ একধরনের বিনোদন উপাদান হয়ে উঠেছে।

গালির ইতিহাস ও ব্যবহার প্রমাণ করে, গালি শুধুই এক ধরনের ‘খারাপ’ ভাষা নয়, বরং এটি ভাষা, সংস্কৃতি, মনোবিজ্ঞান এবং রাজনীতির এক জটিল সংগঠন। সমাজের রীতি-নীতির ওপর নির্ভর করে কোন শব্দ গালি হবে আর কোনটা নয়। তাই আজ যখন আমরা বলি গালি সমাজে অগ্রহণযোগ্য, তখন ভাবতে হয়—এই সমাজ কাদের জন্য গালি নির্ধারণ করছে?

ভবিষ্যতে, ভাষা এবং সমাজের সম্পর্ক নতুন রূপ নিলে গালির সংজ্ঞাও বদলাবে। হয়তো তখন গালি শুধুই ‘অশালীনতা’ নয়, বরং একধরনের সাংস্কৃতিক বার্তা হয়ে উঠবে।

রেফারেন্স:

Related posts

জামদানি – রঙে নকশায় তাঁতে লেখা কবিতা

কীভাবে আপনার হাতে এলো ‘শপিং ব্যাগ’

লিপস্টিক এর ইতিহাস- যেভাবে লিপস্টিক হয়ে উঠলো নারী স্বাধীনতার প্রতীক

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More