“একটি দেশ, সমাজ বা আমাদের ছোট এলাকায় আমাদের সাথে কেমন মানুষ বাস করবে, তার পেছনে যে শক্তিটি কাজ করে তা হলো, তাদের লালন-পালনের ধরন। কিন্তু আজকের প্যারেন্টিং কি আদৌ শিশুদের বিকাশ ঘটাচ্ছে নাকি তাতে বাধা সৃষ্টি করছে?”
আমাদের সমাজের সব কিছুর মূলে একটি বিষয় খুব গভীরভাবে দায়ী, আর তা হলো একজন বাবা-মায়ের শিশু লালন-পালন। একটি দেশ, সমাজ বা আমাদের ছোট এলাকায় আমাদের সাথে কেমন মানুষ বাস করবে, তার পেছনে যে শক্তিটি কাজ করে তা হলো—তাদের শৈশব, তাদের বেড়ে ওঠা, এবং সবচেয়ে বড় কথা, তাদের লালন-পালনের ধরন।
আমাদের বাবা-মায়েরা বংশপরম্পরায় তাদের আশেপাশের অভিভাবকদের দেখেই শিখে আসছেন কীভাবে সন্তান বড় করতে হয়। এই চর্চাটা বলা যায় অনেকটাই অভিজ্ঞতা নির্ভর। শিশুর কান্নায় কীভাবে প্রতিক্রিয়া দিতে হবে, নাকি তা উপেক্ষা করতে হবে, কখন তাদের সাথে শক্ত হতে হবে—এসব সিদ্ধান্ত বহু ক্ষেত্রেই তারা নিয়ে থেকেন তাদের পারিপার্শ্বিকভাবে দেখা ও শেখা আচরণ অনুসরণ করে।
কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এখন এমন অনেক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছ যার সাথে তারা নিজেরাও পরিচিত নয়। এই অবস্থায় তারা কি ধরনের প্যারেন্টিং স্টাইল গ্রহণ করছে? তাদের প্যারেন্টিং কি আদৌ শিশুদের বিকাশ ঘটাচ্ছে নাকি তাতে বাধা সৃষ্টি করছে?
শিশু লালনে পরিবর্তনঃ অল্টারনেটিভ প্যারেন্টিং
একটা সময় ছিল, যখন শিশুরা বড় হতো “বড়দের কথা শুনো”, “তুমি ছোট”, “এটা করো না” এইসব একতরফা শক্ত নির্দেশনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সময় বদলেছে, আজকের বাবা-মায়েরা শুধু আদেশ-নিষেধ নয়, বরং সন্তানের সঙ্গে এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়তে চান, যেখানে তাদের মধ্যে থাকবে বোঝাপড়ার ও সহানুভূতি। এই পরিবর্তনের নামই অল্টারনেটিভ প্যারেন্টিং।
অল্টারনেটিভ প্যারেন্টিং হলো এমন এক অভিভাবকত্বের ধারা, যেখানে শিশুর মানসিক, আবেগিক এবং সামাজিক বিকাশকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাকে স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করা হয়। তাদের উপর কোনোকিছু চাপিয়ে দেওয়া হয় না। এটি অনেকটাই ট্র্যাডিশনাল প্যারেন্টিংয়ের বিপরীত।
কিন্তু কেন এই পরিবর্তন? কারণ, এখনকার সময় অনেক বেশি জটিল এবং গতিময়। প্রযুক্তির ভারে শিশুরা আগের চেয়ে অনেক বেশি তথ্যের মুখোমুখি হচ্ছে। ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, ডিজিটাল শিক্ষা, আর চারপাশের দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজের বাস্তবতায় তাদের চিন্তা-ভাবনা আগের চেয়ে অনেক ভিন্নভাবে গড়ে উঠছে। এই দ্রুত পরিবর্তনে তৈরি হচ্ছে প্রজন্মের মধ্যে গভীর পার্থক্য- বড় ধরনের জেনারেশন গ্যাপ। আজকাল এমনও দেখা যায়, মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানেই প্রজন্মের মধ্যে মানসিকতা, মূল্যবোধ ও চিন্তাধারায় এতটাই পার্থক্য তৈরি হচ্ছে, যা আগে বাবা-মা আর সন্তানের মধ্যেও এতটা প্রকট ছিল না।
বিকল্প প্যারেন্টিং কেন দরকার?
অল্টারনেটিভ বা বিকল্প প্যারেন্টিং এর মূল মন্ত্র হলো, সবাই আলাদা। প্রতিটি শিশুর ইচ্ছা, ক্ষমতা এবং চাওয়া- পাওয়া আলাদা। তাই এক আঙ্গুলে মাপা এক ধরনের প্যারেন্টিং দিয়ে সব শিশুর সমান মানসিক গঠন হওয়া সম্ভব না। আর তাই বর্তমানের বাবা-মায়েরা পুরোনো ট্র্যাডিশনকে একপাশে রেখে বেছে নিচ্ছেন নিজের সন্তানের স্বভাব-ভিত্তিক প্যারেন্টিং পদ্ধতিগুলো।
আজকের অভিভাবকেরা শুধু সন্তান বড় করছেন না, বরং কীভাবে তাদের বড় করা যায় সেটা নিয়ে প্রশ্নও করছেন। অনেক বাবা-মা নিজের শৈশবে পাওয়া মানসিক চাপ, অবহেলা কিংবা শাসনের কড়া রূপকে পিছনে ফেলে দিতে চান। তারা চেষ্টা করছেন সেই জেনারেশনাল ট্রমার সাইকেল ভাঙতে, যা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে নীরবে চলে এসেছে।
এই বিকল্প প্যারেন্টিং-এ শিশুকে কেবল “ছেলে” বা “মেয়ে”, “ভালো” বা “দুষ্টু” হিসেবে ভাগ করা হচ্ছে না বরং একজন শিশুকে এক সতন্ত্র মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে। যার আলাদা অনূভুতি আছে, মতামত আছে, আর আছে শেখার নিজস্ব গতি। তাই এই প্যারেন্টিংয়ে মূল লক্ষ্য শিশুকে নিজের মতো বেড়ে উঠতে দেওয়া—ভয় নয়, ভালোবাসা দিয়ে। নিয়মের বেড়াজালে আটকে রেখে নয়, বরং বোঝাপড়া ও নিয়মের এক সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলাই এর প্রধান উদ্দেশ্য।
কিছু আলোচিত অল্টারনেটিভ প্যারেন্টিং স্টাইল
জেন্টাল প্যারেন্টিং – আদেশ নয়, আলোচনায় বড় হওয়া
এই পদ্ধতিতে শিশুকে ভয় দেখিয়ে নয়, বুঝিয়ে বড় করা হয়। যখন সে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, বাবা-মা আগে তার কান্নার পেছনের কারণ বোঝার চেষ্টা করেন। আগেই কোন আচরণের কঠোর শাসন না করে তাদের সাথে ধৈর্য ও সহানুভূতির ব্যবহার করা হয়। যুক্তি দিয়ে শিশুকে বোঝানো হয়, যেন সে নিজে থেকেই বুঝে শিখতে পারে।
ইমোশনালি সেফ প্যারেন্টিং– শিশুর মনের বহিঃপ্রকাশ
শিশুদের মনে থাকে এক বিশাল কল্পনার জগৎ। তাদের এই ছোটমনে অনেকরকম অনুভূতির জন্ম হয়। এই প্যারেন্টিং স্টাইলে শিশুকে এমন পরিবেশ দেওয়া হয় যেখানে সে নিঃসংকোচে নিজের এই কথাগুলো বলতে পারে। তাদেরকে “ভয় পেয়েছো?”, “কেন কাঁদছো?”—এই প্রশ্নগুলো করা হয় যাতে তারা শিখে অনুভব লুকানোর কিছু নয় এবং তাদের অনুভূতি শোনার জন্য একটি সেফপ্লেস আছে।
আনস্কুলিং– শেখা মানেই স্কুল নয়
সব কিছু বইয়ে থাকে না। অনেক শিশু ক্লাসরুমে বসে না শিখে, প্রকৃতিতে হাঁটতে হাঁটতে, রান্নাঘরে সাহায্য করতে করতে, কিংবা প্রশ্ন করে করে শিখতে ভালোবাসে। আনস্কুলিং-এ শেখাটাই মুখ্য। বাচ্চার আগ্রহই এখানে সবচেয়ে বড় শিক্ষক। এখানে বাধা ধরা শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে শিশুর শিক্ষা গ্রহনের জন্য এক অন্যরকম পরিবেশ গড়ে তোলা হয়।
কো-প্যারেন্টিং – ভালোবাসার শেষ হলেও দায়িত্ব নয়
সম্পর্ক টিকুক বা না-টিকুক, সন্তানের জন্য বাবা-মা দু’জনই গুরুত্বপূর্ণ। কো-প্যারেন্টং পদ্ধতিতে সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উভয় অভিভাবকেরই শিশুর জীবনে সক্রিয় থাকার গুরুত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাই ডিভোর্স বা সেপারেশনের পরও বাবা-মা দায়িত্ব ভাগ করে সন্তান লালন পালন করে যাতে তাদের বিচ্ছেদ সন্তানের বিকাশে কোনো সমস্যা তৈরি করে ।
এটাচমেন্ট প্যারেন্টিং – হাতের ছোঁয়ায় নিরাপত্তা
একজন মা’র রান্না করতে করতে বাচ্চাকে সাথে রাখা, বুকের দুধ খাওয়ানো, একসাথে ঘুমানো, সবসময়ে নিজের সাথে রাখাই হলো এটাচমেন্ট প্যারেন্টিং-এর চিত্র। শিশুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে তাদের মনে তৈরি করা হয় গভীর নিরাপত্তা ও আস্থাবোধ।
অথারেটিভ প্যারেন্টিং– নিয়মের ভেতর ভালোবাসা
এটা শাসন নয়, গঠন। বাবা-মা শিশুকে স্পষ্ট নিয়ম শেখান, কিন্তু তার মতামতও শোনেন।এখানে তারা যেমন জানতে চায় তাদের সন্তান কি চায় তেমনি তারাও বোঝায় তারা কি চায় শিশুর জন্য এবং কেন চায়। শিশুর সিদ্ধান্তের স্বাধীনতাও থাকে, আবার সীমানাও থাকে। এই ভারসাম্য তাকে শেখায় দায়িত্ববোধ।
পারমিসিভ প্যারেন্টিং– স্বাধীনতা, কিন্তু সীমা জানা জরুরি
এই প্যারেন্টিংয়ে শিশুকে অনেক স্বাধীনতা দেওয়া হয়—সে নিজের পছন্দে অনেক কিছু করতে পারে। তবে স্বাধীনতা মানে যা খুশি তাই করা না। যদি কোনো সিদ্ধান্তের ফলে কিছু ভুল হয় বা হতে পারে, তখন শিশুকে বোঝানো হয় কেন সেটা ঠিক নয় এবং তাকে তা করতে নিষেধ করা হয়। ধীরে ধীরে সে শেখে—সব চাওয়া পূরণ না-ও হতে পারে, আর কখন কোথায় ‘না’ বলা জরুরি।
ফ্রিরেঞ্জ প্যারেন্টিং– নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা
এই পদ্ধতিতে শিশুকে একটু বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হয়। যেমন, ও একা স্কুলে যায়, নিজের ইচ্ছেমতো জামা পরে, এমনকি সে যদি দু পায় একই মোজা নাও পরে তাও তাকে কিছু বলা হয় না! বাবা-মা ভাবেন, ও নিজে কিছু করলে ভুল করতেই পারে, কিন্তু সেই ভুল থেকেই ও সবচেয়ে ভালো শিখবে। কারণ, জীবনে চলতে শিখতে হলে শুধু নিয়ম না, দরকার একটু ঝুঁকি নেওয়াও।
পজিটিভ প্যারেন্টিং– ধমক নয়, দিক দেখানো
শিশু ভুল করলে ধমক নয়, বরং উৎসাহ দেওয়া হয়। “এই কাজটা যদি আবার করতে বলি, তুমি কীভাবে করবা?”-এইরকম প্রশ্ন করে তাকে তার কাজের ফল বোঝানো হয়। এই প্রশ্ন করা তাকে ভাবতে শেখায়। এখানে অভিভাবক চেষ্টা করে শিশুর আচরণের পেছনের কারণ এবং সে অনুযায়ী ব্যবহার করেন। তারা সহনশীল ব্যবহারের মাধ্যমে সন্তানের পাশে থাকেন। এই সবকিছু মিলে একটা শ্রদ্ধার সম্পর্ক তৈরি হয়।
শিশুর বিকাশে বিকল্প প্যারেন্টিং
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুরা সহানুভূতিশীল এবং সমর্থনশীল পরিবেশে বড় হয়, তারা অধিক আত্মবিশ্বাসী ও সৃজনশীল হয়ে উঠে এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকে। ড. লরা মার্কহামের গবেষণায় দেখা গেছে, জেন্টল প্যারেন্টিং পদ্ধতি শিশুদের মধ্যে নিরাপদ সংযুক্তি, সহানুভূতি এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। এই পদ্ধতি শিশুদের আবেগ প্রকাশের জন্য একটি নিরাপদ ও সমর্থনশীল পরিবেশ তৈরি করে, যা তাদের আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা গঠনে সহায়তা করে ।
এছাড়াও, দেখা গেছে যে, পিতামাতার ধারণা, শৈলী এবং নির্দিষ্ট আচরণ শিশুদের সৃজনশীল প্রবণতা গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে। তাদের আচরণই নির্ধারণ করে তাদের শিশুরা কতদূর এগিয়ে যাবে।অল্টারনেটিভ প্যারেন্টিং এই ধরনের পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করে। এটি শিশুকে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে, সিদ্ধান্ত নিতে এবং ভুল থেকে শিখতে উৎসাহিত করে।
তাহলে কি ট্র্যাডিশনাল প্যারেন্টিং ভুল?
না। ট্র্যাডিশনাল প্যারেন্টিংয়ের অনেক শক্ত ভিত্তি আছে যেমন সংযম, শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ যা একজন শিশুপালনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ চর্চা। কিন্তু সমস্যা হয় দাঁড়ায় যখন সেই শৃঙ্খলা অন্ধ, আবেগহীন এবং শিশুর কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেয়। তাই অল্টারনেটিভ প্যারেন্টিং মানে ট্র্যাডিশনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নয়, বরং তা পুনরায় আবিষ্কার।
বাঙালি পরিবারে বিকল্প প্যারেন্টিং কতটা সম্ভব?
আমাদের সংস্কৃতিতে দাদি-নানির কড়া শাসন, শিশুকে প্রশ্ন না করা এখনো প্রচলিত। এখনো আমাদের দেশে সন্তানদের কাছে অকল্পনীয় প্রত্যাশা রাখা হয় যাতে তাদের উপর চাপের সৃষ্টি হয়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত সম্মানের আশায় বাবা-মায়েরা সন্তান্দের ইচ্ছা এবং গুনকে অবহেলা করে। তাদের উপর নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। এই ধরনের প্যারেন্টিং এখনো আমাদের দেশে প্রচলিত।
তবে, ইউটিউব, গল্পের বই, আর সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে। অনেক বাবা-মা নিজের ছোটবেলার অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পারছেন—শুধু আদেশ নয়, ভালোবাসা, বোঝাপড়া আর সংলাপই পারে শিশুকে সুস্থভাবে গড়ে তুলতে।
এই সবের মাঝে একটি সুন্দর দিক হলো এখন কোথাও কোথাও দাদা-দাদির ট্রাডিশনাল শাসন এবং বাবা-মায়ের বিকল্প লালনের সংমিশ্রণে গড়ে উঠছে এক অদ্ভুত শিক্ষণীয় ও ভালোবাসার পরিবেশ। যেখানে শিশুরা যেমন স্বাধীনতা পাচ্ছে তেমনি তাদের দাদা-দাদির প্রজন্মের কঠোর শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাও বুঝতে পারছে। বুঝতে পারছে এর পিছনে থাকা নৈতিক মুল্যবোধ। কেননা সব প্যারেন্টিং এর মূলে শুধু একটাই চাওয়া-সন্তানের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। শুধু দরকার একটু সহানুভূতি ও ব্যালেন্স!