জাপানের যে দ্বীপটি একসময় জেলেপল্লি হিসেবে পরিচিত হলেও, বর্তমানে বিড়ালদের দ্বীপ নামেই সকলের কাছে পরিচিত।
জাপানের অধিবাসীদের বিড়ালপ্রীতি যেন অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে একটু বেশি। এই তো কয়েক বছর আগের কথা; জাপানে রাজকীয় আড়ম্বরে মধ্য দিয়ে একটি বিড়ালের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো। হবেই না বা কেন! সে তো আর যেকোনো সাধারণ বিড়াল নয়; জাপানের পশ্চিমাঞ্চলের একটি স্থানীয় রেলওয়েতে টানা আট বছর স্টেশন মাস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে সে! তার নাম ছিল ‘টামা’। যাকে জাপানের রেলব্যবস্থার ‘অফিসিয়াল মুখ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। টামার মৃত্যুর পর তার স্থানে আরেক বিড়াল ‘নিতিমা’-কে নিযুক্ত করা হয়েছে।
আবার যে ডোরেমন নিয়ে ঘরে-বাইরে বাচ্চাদের মধ্যে এতো উচ্ছাস চোখে পড়ে, তার মূল চরিত্র “ডোরেমনও” সেই বিড়ালেরই একটি রূপ। তবে আজকের আলোচনার বিষয় ডোরেমন বা টামা নয়। বরং এমন এক বিস্ময়কর দ্বীপ, যেখানে মানুষ নয়, বিড়ালরাই প্রধান অধিবাসী। অনেকে যাকে বিড়ালদ্বীপ বা ক্যাট আইল্যান্ডও বলে থাকে।
জাপানে এমন অনেক দ্বীপ আছে, যেখানে বিড়ালের আধিপত্য। এমনই এক দ্বীপ আয়োশিমা। দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দ্বীপটি একসময় জেলেপল্লি হিসেবে পরিচিত হলেও এখন বিড়ালদের দ্বীপ নামেই চেনেন সবাই।
আয়োশিমা দ্বীপটি জাপানের এহিমে (Ehime) প্রদেশের অন্তর্গত, যা শিকোকু দ্বীপের বেশ কাছে অবস্থিত। এর আয়তন মাত্র ১.৬ বর্গ কিলোমিটার।এটি অনেকের কাছে জেলেপল্লী হিসেবেও পরিচিত। এটা সময় ছিলো যখন এখানে প্রায় ৯০০ জনের মতো মানুষ বাস করতেন। কিন্তু আজ সেখানে মাত্র ১০ থেকে ১৫ জনের মতো স্থায়ী বাসিন্দা আছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই প্রবীণ।
তবে মজার বিষয় হলো, দ্বীপটিতে এখন প্রায় ১২০ থেকে ১৫০টি বিড়াল রয়েছে! এখানকার বিড়ালগুলো আধবুনো বা বন্যার মতো হলেও, মানুষের সঙ্গে তারা সম্পূর্ণ অভ্যস্ত। এমনকি যখন পর্যটকরা দ্বীপে আসেন, তখন এই বিড়ালরা খুশিমনে তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করে। কারণ বিড়ালদের জানা আছে, পর্যটকের আগমন মানেই সঙ্গে করে টুনা মাছের ক্যানসহ নানা ধরনের মুখরোচক খাবার নিয়ে আসা। আরও অবিশ্বাস্য বিষয় হলো,দ্বীপটির একমাত্র কমিউনিটি সেন্টারটির পাশই বিড়ালদের খাওয়ানোর একটি বিশেষ জায়গাও আছে।
বিড়াল কাহিনির সূচনা: কিভাবে এত বিড়াল এল?
দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক ভিড় করছেন এই দ্বীপে, বিড়ালের অভয়ারণ্য দেখার জন্যে। প্রতিদিন একটি ট্রলার দু’বার আসা যাওয়া করে ভ্রমণপিপাসুদের পারাপারের জন্যে।
প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কী করে এলো এত বিড়াল? এর পিছনের গল্পটিও বেশ মজার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়েও এই এলাকায় বেশ মানুষজন ছিল। তাদের মূল জীবিকা ছিল মৎস্য আহরণ। আর দ্বীপের চারপাশ মাছ শিকারের জন্য বেশ অনুকূলও ছিল। সেইসময় এই দ্বীপে টেক্সটাইলের জন্য এক ধরনের শূককীটও উৎপাদন করা হতো। কিন্তু ইঁদুরের যন্ত্রণায় এই কাজ বেশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। আবার জেলেদের জালগুলোও প্রায় প্রতিদিন কেটে দিচ্ছিল বিচ্ছু ইঁদুরের দল। ইঁদুরের উৎপাতে জেলেরা পড়ে গেল মহা মুশকিলে। আর সেই জেলেরা তেমন সচ্ছলও ছিল না যে, চটজলদি কোনো সমাধান বের করতে পারবে।
অবশেষে তারা একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেন—শহর থেকে কিছু বিড়াল এনে দ্বীপে ছেড়ে দেওয়া হবে, যাতে ইঁদুরদের দমন করা যায়। কয়েকদিনের মধ্যেই আশানুরূপ ফল পাওয়া গেল।কয়েকদিনের মধ্যেই ইঁদুরের উপদ্রব থেকে রেহাই মেলে, আর বিড়ালগুলোও হয়ে ওঠে দ্বীপের স্থায়ী বাসিন্দা।
এদিকে দিন দিন দ্বীপে জীবন ধারণ করা কষ্টসাধ্য হতে লাগল মানুষের জন্য। শুধু মাছ ধরে আর সেভাবে চলছিল না। পাশাপাশি দ্বীপে তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধাও ছিল না। ছিল না কোনো স্কুল, হাসপাতাল, এমনকি বাজারও। আগে বাচ্চাদের একটি স্কুল ছিল, কিন্তু সেটিও বন্ধ হয়ে যায় ১৯৮৯ সালের দিকে। ফলে লোকজন অন্য জীবিকার সন্ধানে শহরের দিকে স্থানান্তরিত হতে শুরু করে। সুযোগ-সুবিধার অভাবের কারণে অন্য জায়গা থেকেও লোকজনের খুব একটা এই দ্বীপে আসা হতো না। দিন দিন দ্বীপটিতে একদিকে সাধারণ লোকসংখ্যা কমতে থাকে, আর অন্যদিকে বিড়ালদের বংশবিস্তার ঘটতে থাকে। আর এভাবেই দ্বীপে মানুষের চাইতে বিড়ালের সংখ্যা বেশি হয়ে পড়ে।
বিড়ালই যেন এখন তাদের একমাত্র সঙ্গী!
এই দ্বীপে যারা কিছুটা শক্ত-সামর্থ্য ছিল বা যাদের কাজ করার কিছুটা ক্ষমতা ছিল, তারা সকলেই এই দ্বীপ ছেড়ে চলে গেছে। আছেন কেবল ষাটোর্দ্ধ বয়সের বৃদ্ধ জনগণ। তাদের কেউ কেউ মাছ শিকার করেন, আবার কেউ কেউ গাইডের কাজও করে থাকেন। এই বয়স্ক লোকদের আপন বলে কেউ আর সেখানে থাকে না। সকলেই চলে গেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। তাই এই আত্মীয়-স্বজনহীন দ্বীপে বিড়ালগুলোই যেন তাদের একমাত্র অবলম্বন। তারাও বিড়ালগুলোকে দেখে-শুনে রাখার জন্যই যেন বেঁচে থাকা।
বিশ্বজুড়ে খ্যাতি: ক্যাট ট্যুরিজম ও সামাজিক মাধ্যম
২১শ শতকের শুরুতে ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমের বিস্তারের ফলে এই দ্বীপ দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিছু পর্যটক এবং ভ্লগের এখানে গিয়ে বিড়ালের সাথে কাটানো বেশকিছু মুহূর্তগুলো ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করতে শুরু করেন। সেই ভিডিওগুলোও ভাইরাল হতে সময় লাগেনি। ‘Cat Island’ শব্দটি গুগলে সার্চ দিলেই এখন অসংখ্য ছবি ও ব্লগ পাওয়া যায়।
এই খ্যাতি শুধু আয়োশিমার নয়, জাপানে এমন আরো কয়েকটি ক্যাট দ্বীপ রয়েছে যেমন— তোশিরোজিমা (Tashirojima), ওগিজিমা (Ogijima), এনোজিমা (Enoshima) ইত্যাদি। আয়োশিমা সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং রহস্যময় দ্বীপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
জাপানের সংস্কৃতি-অর্থনীতি ও ক্যাট ট্যুরিজম
জাপানের মানুষের মধ্যে বিড়ালের প্রতি এক ধরনের বিশেষ স্নেহ, মমতা ও শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে।
প্রচলিত লোকগাঁথা ও সংস্কারে বিড়ালকে অনেক সময়ই দেখা হয় আধ্যাত্মিক শক্তির ধারক হিসেবে।
এমনকি জাপানি সংস্কৃতিতে বিড়াল হলো সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির প্রতীক। আর এই বিশ্বাস থেকেই বহু ব্যবসায়ীর দোকানে দেখা যায় আঙুল নাড়ানো বিড়ালের (মানেকি নেকো) মূর্তি। জাপানের দোকানদাররা বিশ্বাস করেন যে, এর থাবা ক্রেতা টেনে আনে। আবার অনেকের বিশ্বাস, বিড়ালকে যত্ন করে লালনপালন করলে ঘরে সৌভাগ্য, সুখ ও সম্পদ আসে।
আর এই সংস্কার ও ভালোবাসার একটা বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় আয়োশিমা দ্বীপে। এই দ্বীপে পর্যটকরা মূলত বিড়াল দেখতে, ছবি তুলতে এবং খাওয়াতে আসেন।তবে দ্বীপে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকান বা থাকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায়, বেশিরভাগ পর্যটকই দিনের বেলা ঘুরে সন্ধ্যার আগেই ফিরে যান।
তবুও এই ক্ষণস্থায়ী উপস্থিতি দ্বীপে এনে দিয়েছে এক নতুন অর্থনৈতিক গতি। প্রবীণ বাসিন্দারা এখন বিড়াল-থিমযুক্ত হস্তশিল্প, স্মারক সামগ্রী ও খাবার বিক্রি করে কিছু অতিরিক্ত আয় করছেন। আবার কেউ কেউ স্থানীয় গাইড হিসেবে কাজ করছেন।এক সময় যে দ্বীপ নিঃসঙ্গতা ও জনবিরলতায় ডুবে গিয়েছিল, আজ সে দ্বীপ বিড়ালের হাত ধরেই ফিরে পাচ্ছে নতুন প্রাণ, নতুন অর্থনীতি ও নতুন চেহারা।
সমস্যার দিক: অতিরিক্ত বিড়ালের ঝুঁকি
যদিও ক্যাট আইল্যান্ড ব্যাপারটা শুনতে চমৎকার লাগে, তবে এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। uncontrolled breeding বা অনিয়ন্ত্রিত প্রজননের কারণে অনেক বিড়াল অপুষ্টিতে ভুগছে। পাশাপাশি অনেক বিড়ালের বিভিন্ন রোগ হচ্ছে, যেগুলোর চিকিৎসার ব্যবস্থা সেখানে নেই।
সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন কয়েকবার বিড়ালদের sterilization (প্রজনন ক্ষমতা বন্ধ করার অপারেশন) করার উদ্যোগ নেয়, কিন্তু তাতে সব বিড়ালকে কভার করা সম্ভব হয়নি। সেই সঙ্গে রয়েছে খাদ্য সরবরাহ ও আবাসন সংকট। অনেক পর্যটক বিড়ালদের খাওয়ালেও, সেটা পর্যাপ্ত নয়। ফলে, দ্বীপের ভারসাম্য রক্ষা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভবিষ্যৎ ভাবনা ও টেকসই পরিকল্পনা
এই দ্বীপের বিড়ালদের সুরক্ষার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোত্তম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে কুকুর পোষা এবং বাইরে থেকে কুকুর নিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ২০১৩ সালে টুইটারে বিড়াল দ্বীপের প্রসঙ্গে ছবি ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পর্যটকদের নজর কাড়ে এই দ্বীপ। তাশিরোজিমা ছাড়াও জাপানের আরেকটি বেশ জনপ্রিয় বিড়াল দ্বীপ রয়েছে, যেটি আওশিমা নামে পরিচিত। জাপানি ভাষায় এসব দ্বীপকে বলা হয় নেকোজিমা অর্থাৎ বিড়ালের দ্বীপ।
তবে জাপান ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াতেও যথাক্রমে ১৫ থেকে ১৮টি এমন দ্বীপ দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেসব দ্বীপ অনেকটাই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে করা। জাপানের এই বিড়াল দ্বীপগুলো প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে। জাপান এই বিড়ালপ্রীতি যে শুধু দ্বীপেই ধরে রেখেছে তেমন নয়, পুরো দেশে ক্যাট-ক্যাফে, ক্যাট-সাইন ও ‘হ্যালো কিটি’ নামে প্রচুর ক্যাট-শপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ক্যাট আইল্যান্ড ছাড়াও জাপানে র্যাবিট আইল্যান্ড ও ফক্স আইল্যান্ডও বেশ জনপ্রিয়।
ক্যাট আইল্যান্ডের গল্প আমাদের শেখায় এক অন্যরকম মানবতা যেখানে প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধ। এই দ্বীপ শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, বরং এটি একটি বেঁচে থাকা জীবন্ত গল্প। যেখানে মানুষ আর বিড়ালের মধ্যে গড়ে উঠেছে অদ্ভুত কিন্তু অসাধারণ সম্পর্ক। আধুনিক পৃথিবীর চাপে এই সম্পর্ক হয়তো বিলীন হয়ে যেতে পারে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত আয়োশিমা দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্য নিদর্শন হয়ে।যাকে ক্যামেরায় ধরা যায়, কিন্তু হৃদয়ে অনুভব করাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।