কুকিজ আপনার ব্রাউজিংকে সহজ করলেও, এগুলি আপনার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট ট্র্যাক করে। কিন্তু সচেতন না হলে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য হয়ে উঠতে পারে বিজ্ঞাপনদাতাদের হাতিয়ার।
আপনি কি খেয়াল করেছেন, অনেক ওয়েবসাইটেই ঢুকতেই একটা ছোট পপ-আপ ভেসে ওঠে “Accept All Cookies” অথবা “Reject All Cookies”? আমাদের অনেকেই না ভেবেই ‘Accept’ বাটনটায় চাপ দিয়ে ফেলি। কেন? কারণ, মনে হয় “Accept” না করলে সাইটটাই ব্যবহার করতে পারব না!
কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছেন, এই ‘কুকি’ জিনিসটা আসলে কী? এটা আমাদের জন্য সুবিধা, না কি এক ধরনের প্রযুক্তিগত ফাঁদ? আর যখন পপ-আপ আসে, তখন কি আসলেই ‘Accept’ করা উচিত নাকি ‘Reject’ করা উচিত। আজকের এই ব্লগে থাকছে এর সহজ ব্যাখ্যা।
কুকি আসলে কী?
কুকি একটি ছোট ফাইল, যা কোনো ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে ব্যবহারকারীর কম্পিউটার বা মোবাইলে জমা হয়। এটি ব্যবহারকারীর তথ্য, পছন্দ বা লগইন তথ্য সংরক্ষণ করে রাখে। অনলাইন শপিং, ভাষা বা ব্রাউজিং ইতিহাস মনে রাখার জন্য কুকি ব্যবহার হয়। কুকি সাধারণত ক্ষতিকর নয়, চাইলে কুকি ডিলিট বা বন্ধ করা যায়।
কুকিজকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়; সেশন কুকিজ ও পারসিস্টেন্ট কুকিজ। সেশন কুকিজ অস্থায়ী হয়। ধরুন আপনি শপিং কার্টে কিছু পণ্য যোগ করলেন। এই তথ্যটি কুকিজের মাধ্যমে রাখা হয় যতক্ষণ না আপনি সাইটটি বন্ধ করছেন। সেশন শেষ হলে এই কুকিজগুলোও মুছে যায়।
অন্যদিকে, পারসিস্টেন্ট কুকিজ অনেকদিন থেকে যায়। যেমন আপনি যদি কোন ইমেইল অ্যাকাউন্টে লগ ইন করলেন। এরপর লগইন করতে আর পাসওয়ার্ড দেয়া লাগছে না। এক্ষেত্রে পারসিস্টেন্ট কুকিজ আপনার তথ্য জমা রাখে। এর মেয়াদ কয়েক দিন থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত হতে পারে।
কুকিজ অপশন মানে কী?
প্রতিটি ওয়েবসাইটেই বলা থাকে তারা “essential cookies” ব্যবহার করে। অনেক সময় এগুলো ছাড়া সাইট কাজই করে না। যেমন শপিং কার্ট, লগ ইন সিস্টেম বা ওয়েবসাইটের মূল কার্যপ্রবাহ। আপনি এগুলো থেকে মুক্তি পেতে পারবেন না। কারণ সাইটের মূল ফিচারগুলো না চললে আপনি নিজেই সমস্যায় পড়বেন।
তবে আপনি যেটা কন্ট্রোল করতে পারেন তা হল “non-essential cookies”। এগুলোকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথমত, ফাংশনাল কুকিজ। এগুলো আপনার ব্যক্তিগত ব্রাউজিং অভিজ্ঞতা আরও সহজ করে তোলে। যেমন, নির্দিষ্ট ভাষা বা অঞ্চল বেছে নেওয়া।
দ্বিতীয়টি হল অ্যানালিটিক্স কুকিজ। এগুলো সাইট মালিকদের তথ্য দেয় যে ব্যবহারকারীরা কীভাবে সাইট ব্যবহার করছে, কোন পেইজে বেশি সময় কাটাচ্ছে, ইত্যাদি।
তৃতীয়ত, অ্যাডভারটাইজিং কুকিজ। এসব কুকিজ আপনার উপর একটি প্রোফাইল তৈরি করে এবং তার উপর ভিত্তি করে টার্গেটেড বিজ্ঞাপন দেখায়। এই ধরনের কুকিজ সাধারণত তৃতীয় পক্ষের হয়ে কাজ করে। যেমন Google Ads, এই কুকিজ ব্যবহার করে আপনার অনলাইন আচরণ ট্র্যাক করে।
একবার গুগলে লগ ইন করা অবস্থায় তারা আপনার সার্চ হিস্টোরির সাথে সাথে ইউটিউবে কী দেখলেন বা অন্য সাইটেও কী করলেন, সেটাও তারা বুঝতে পারে। কারণ সবই একেকটা সেই একাউন্টের সাথে যুক্ত।
তাহলে কুকিজ অ্যাকসেপ্ট করা উচিত, না রিজেক্ট?
এটা সম্পূর্ণ আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আপনি যদি “Accept All” বাটন চাপ দেন, তাহলে আপনি সেই ওয়েব সাইটকে সব ধরণের কুকিজ ব্যবহারে সম্মতি দিচ্ছেন। এর মানে হল, সাইটের সব ফিচারই আপনার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এমনকি কাস্টোমাইজড বিজ্ঞাপনও।
অন্যদিকে, আপনি যদি “Reject All” করেন বা সেই পপ-আপটা এড়িয়ে যান শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় কুকিজ ছাড়া সব কিছু বন্ধ থাকবে। এতে সাইট ব্যবহার করা সম্ভব হবে, কিন্তু ব্যক্তিগত সুবিধাগুলো, যেমন প্রোডাক্ট সাজেশন, রিজিওনাল সেটিংস বা টার্গেটেড অ্যাডস পাবেন না। এই সেটিংস একটি কনসেন্ট কুকির মাধ্যমে সেভ হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে সাধারণত ৬ থেকে ১২ মাস পর আপনার সামনে এই সেটিংস আস্তে পারে।
তবে ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় “Cookie Settings” থেকে এই পছন্দ পরিবর্তন করা যায়। এই অপশনটি সাধারণত ওয়েবসাইটের নিচে ফুটারে থাকে। কখনও কখনও এটি “Privacy Policy” বা “Cookie Policy”-র মধ্যেও থাকে।
গোপনীয়তা এবং কুকিজ
আমরা কেন এত বেশি কুকিজ পপ-আপ দেখি? এর পিছনে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি গোপনীয়তা আইন, GDPR (General Data Protection Regulation)। এটি ২০১৮ সালে চালু হয়। এই আইনে বলা হয়, “যদি কোনো কুকিজ, ব্যবহারকারীর পরিচয় নির্ধারণ করতে পারে। তাহলে সেটিকে ব্যক্তিগত ডেটা হিসেবে ধরা হবে এবং সেক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর সম্মতি বাধ্যতামূলক।”
এই আইন অনুযায়ী:
- ব্যবহারকারীর সম্মতি ছাড়া কোনো কুকিজ ব্যবহার করা যাবে না (যদি সেটা প্রয়োজনীয় না হয়),
- কুকিজ কী ধরণের তথ্য সংগ্রহ করে, সেটা স্পষ্ট করে জানাতে হবে,
- সম্মতি সংরক্ষণ ও ডকুমেন্ট করতে হবে,
- ব্যবহারকারী যেন কুকিজ ছাড়া ওয়েবসাইট ব্যবহার করতে পারে, সেই নিশ্চয়তা থাকতে হবে,
- এবং যেকোনো সময় ব্যবহারকারী যেন তার সম্মতি প্রত্যাহার করতে পারেন, সেটারও সু্যোগ থাকতে হবে।
এই আইন যদিও ইউরোপে চালু, তবুও অনেক ওয়েবসাইট সারা বিশ্বেই এর নিয়ম মেনে চলে।
আরও ভালো গোপনীয়তা কনট্রোলের উপায়
কুকিজ পপ-আপ দেখে অনেকেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। একে বলা হয় “consent fatigue”। মানে মানুষ ভাবতেই চায় না কী হচ্ছে, কী হচ্ছে না, সরাসরি সব মেনে নেয়। এতে আসলে আমাদের গোপনীয়তা রক্ষা হয় না।
এই সমস্যার আরও ভালো সমাধান হতে পারে “Global Privacy Control” বা GPC। এটি অনেক ওয়েব ডেভেলপার, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, এবং সিভিল রাইটস সংগঠন একত্রে তৈরি করেছে। এটি ব্রাউজারের সেটিংসের মাধ্যমেই আপনার সব কুকিজ সম্পর্কে জানিয়ে দেয়। যদিও এটি এখনও সব জায়গায় চালু হয়নি। তবে কিছু ব্রাউজার ও এক্সটেনশন এটি সাপোর্ট করে। সময়ের সাথে সাথে এর ব্যবহার বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আপনি যদি কুকিজ ডিলিট করতে চান তাহলে,
ক্রোমে: Settings > Privacy and Security > Clear Browsing Data > Cookies.
ফায়ারফক্সে: Settings > Privacy & Security > Cookies and Site Data > Clear Data.
এই অপশনে গিয়ে ডিলিট করতে পারবেন।
কুকিজ আপনার ব্রাউজিংকে সহজ করলেও, এগুলি আপনার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট ট্র্যাক করে। কিন্তু সচেতন না হলে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য হয়ে উঠতে পারে বিজ্ঞাপনদাতাদের হাতিয়ার। তাই, সব কিছু Accept করার আগে একবার ভাবুন। নিজের গোপনীয়তা নিজেই রক্ষা করুন।